Type Here to Get Search Results !

সবুজ বিপ্লব কাকে বলে

 বিপ্লব কথাটির অর্থ হল আমূল পরিবর্তন। কৃষি ক্ষেত্রে ফসল উৎপাদনের ব্যাপক পরিবর্তনই হলো সবুজ বিপ্লব। নির্বাচিত কৃষি এলাকায় ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে নেওয়া কার্যক্রমকেই সবুজ বিপ্লব বলে। ভারত স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে কৃষি যোগ ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করার চেষ্টা করেছে। 1965-66 সালের মধ্যে সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে ভারতে কৃষিজ উৎপাদন বিপুল বৃদ্ধি পায়।



ঐতিহাসিক পটভূমি: 

মেক্সিকোর গম উন্নয়ন কর্মসূচির কর্ণধার নরম্যান বোরলগ 1951 খ্রিস্টাব্দে উচ্চ ফলনশীল গম বীজের উদ্ভাবনের মাধ্যমে সবুজ বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। 1961 খ্রিস্টাব্দে মেক্সিকোর মোট গম উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়িয়ে ছিল পূর্বের উৎপাদনের 2.5 গুণ। ভারতে সবুজ বিপ্লবের প্রণেতা ডঃ এম এস স্বামীনাথন।


সংজ্ঞা: 1960 এর দশকে কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক উপকরণের প্রয়োগ শুরু হয়। এই সময় মূলত জলসেচের প্রসার, উচ্চ ফলনশীল বীজের ব্যবহার, রাসায়নিক সারের ব্যবহার, কীটনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমভাগে কৃষিজাত ফসল উৎপাদনের বিপুল অগ্রগতি দেখা যায় একে সবুজ বিপ্লব বলে।


সবুজ বিপ্লবের উপকরণ: 

কৃষি ক্ষেত্রে যে সকল কৌশল অবলম্বন করে কৃষিজাত ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করা হয় তা সবুজ বিপ্লবের উপকরণ নামে পরিচিত। এই বিপ্লবের ক্ষেত্রে মূলত 12 টি উপকরণ নির্দিষ্ট করা হয়।


১. উচ্চফলনশীল বীজ: সবুজ বিপ্লবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হলো উচ্চফলনশীল বীজের ব্যবহার। দেশীয় বীজের পরিবর্তে এই বীজের উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেশি। গম, ধান, জোয়ার, বাজরা এবং ভুট্টার ক্ষেত্রে উচ্চফলনশীল বীজ সীমাবদ্ধ।


২. রাসায়নিক সার: উচ্চ ফলনশীল বীজ ব্যবহার করার জন্য প্রচুর রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় জমিকে সঠিকভাবে উর্বরতা প্রদান না করতে পারলে ফসল উৎপাদন অধিক পাওয়া যাবে না।


৩. জলসেচ: উচ্চফলনশীল বীজের জন্য প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে জলসেচ। ভূপৃষ্ঠের জলের পাশাপাশি ভৌমজলের সাহায্যে জমিতে জল দেওয়া হয়।


৪. কীটনাশক ঔষধ: ভিনদেশে উচ্চফলনশীল বীজের সাহায্যে প্রচুর পরিমাণে ফসল উৎপাদন করতে কীটনাশকের বিপুল ব্যবহার করা হয়।


৫. ভূমিসংস্কার: জমির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ভূমিসংস্কারের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। জমিদারি প্রথার বিলোপ ঘটিয়ে, অপারেশন বর্গা, জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণের মধ্য দিয়ে কৃষিক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা হয়।


৬. পাট্টা বিলি: ভারতের কৃষি উন্নতির জন্য ক্ষুদ্র এবং পতিত ভূমিকে কৃষকের মধ্যে বিলি করে পাট্টা তহবিল গঠন করা হয়। এর ফলে কৃষকদের মধ্যে শস্য উৎপাদনের আগ্রহ দেখা যায়।।


৭. ঋণের ব্যবস্থা: উচ্চ ফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ইত্যাদির জন্য পর্যাপ্ত অর্থের প্রয়োজন এই কারণে গ্রামাঞ্চলে সহজ শর্তে ব্যাংকের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার কৃষি ঋণ বিলি করা হয়।

৮. বৈদ্যুতিকরণ: পাম্পের সাহায্যে জলসেচের জন্য সস্তায় বিদ্যুতের সরবরাহ করা প্রয়োজন। পাঞ্জাব, অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাট প্রভৃতি রাজ্যে প্রায় প্রত্যেকটি গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে।


৯. গ্রামের রাস্তা ও বাজার সৃষ্টি: গ্রামের রাস্তার নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ দ্বারা পরিকাঠামোর উন্নতি ঘটিয়ে সবুজ বিপ্লবকে সার্থক রূপ দেওয়া সম্ভব হয়েছে।


১০. যান্ত্রিকীকরণ: পুরানো যন্ত্রপাতির পরিবর্তে আধুনিক যন্ত্রপাতির দ্বারা উৎপাদন সবুজ বিপ্লবের পথকে মসৃণ করতে সাহায্য করেছে। এর ফলে অনেক স্থানে বহু ফসলি উৎপাদন প্রকল্প গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে।



১১. কৃষি বিদ্যালয় স্থাপন: কৃষিক্ষেত্রে নতুন কৌশল প্রবর্তনের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষি বিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়েছে।


১২. কম্যান্ড এরিয়া উন্নয়ন: ভূমি জরিপ করে, ভূমির আকৃতি নির্ণয়, জমির মধ্যে খাল খনন, সঠিক নিষ্কাশন ইত্যাদির উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে। এছাড়াও সঠিক শস্যবিন্যাস, রক্ষণাবেক্ষণ ও জলসেচের আধুনিকীকরণও এই প্রকল্পের অন্তর্গত ছিল।


পর্যায়: সবুজ বিপ্লবের পর্যায় কে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- (i) প্রথম পর্যায়ে 1967-68 থেকে 1981-82 খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময় সবুজ বিপ্লবের প্রথম পর্যায়ের অন্তর্গত।

(ii) দ্বিতীয় পর্যায়ে: 1981-82 খ্রিষ্টাব্দ থেকে 1991-92 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল দ্বিতীয় পর্যায়ের অন্তর্গত।


সবুজ বিপ্লবের প্রভাব 

ভারতীয় কৃষিতে সবুজ বিপ্লবের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

ক. সুফল: সবুজ বিপ্লবের ফলে ভারতের কৃষিক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল। গুরুত্বপূর্ণ সুফলগুলি হল,- 

(i) মোট উৎপাদন বৃদ্ধি: সবুজ বিপ্লবের ফলে ভারতের কৃষিজাত ফসল এর উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল 8.2 কোটি টন 2011-12 সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় 25.74 কোটি টন।


(ii) হেক্টর প্রতি উৎপাদন বৃদ্ধি: উচ্চফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার, জলসেচের সুবিধা, কীটনাশক প্রভৃতি প্রয়োগ করার ফলে হেক্টর প্রতি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। 1970-71 সালে খাদ্যশস্যের গড় হেক্টর প্রতি উৎপাদন ছিল 872 কেজি। 2009-10 খ্রিস্টাব্দে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় 1800 কেজি।


(iii) খাদ্যের অভাব পূরণ: স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ভারতের জনসংখ্যা দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে খাদ্যশস্য সংকট দেখা দেয়। সবুজ বিপ্লবের প্রয়োগের মাধ্যমে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় এই সমস্যার সমাধান হয়েছে।


(iv) কৃষকের আয় বৃদ্ধি: জমি থেকে উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকের আয় বাড়তে থাকে। তাদের জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তন ঘটে।


(v) শিল্পের বিকাশ: সবুজ বিপ্লবের ফলে কার্পাস বয়ন, বনস্পতি শিল্পের ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে।


(vi) গ্রামীন কর্মসংস্থান: জমিতে সার প্রয়োগ বহু ফসলি চাষের মাধ্যমে গ্রামের লোকের কাজের সুযোগ বেড়েছে। তবে যান্ত্রিকীকরণের ফলে এই কর্মসংস্থান সম্পর্কে অনেক বিতর্ক রয়েছে।


(vii) কৃষকের মানসিকতার পরিবর্তন: কৃষিক্ষেত্রে কৃষক আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করায় তাদের চিরাচরিত ধারণার পরিবর্তন ঘটে। মানসিকতার পরিবর্তনের ফলে আধুনিক কৃষি পদ্ধতি প্রবর্তন করতে তাদের অসুবিধা হয় না।


খ. কুফল: সবুজ বিপ্লবের সুফল এর পাশাপাশি এর কিছু ক্ষতিকর প্রভাবও রয়েছে। যেমন- 

(i) আঞ্চলিক বৈষম্য সৃষ্টি: সবুজ বিপ্লব ভারতের সর্বত্র সমানভাবে কার্যকর হয়নি। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, এবং উত্তরপ্রদেশে সবুজ বিপ্লবের যতটা সাফল্য দেখা গেছে ভারতের অন্যান্য স্থানে সেটি লক্ষ্য করা যায়নি। এই অসম প্রসারের ফলে আঞ্চলিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক কালে দ্বিতীয় পর্যায়ের সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে সফলতা পাওয়া যাচ্ছে।


(ii) শ্রেণীগত বৈষম্য সৃষ্টি: ধনী চাষী সবুজ বিপ্লবের সুযোগ বেশি মাত্রায় গ্রহণ করে আরো বেশি সচ্ছল জীবনযাপন করে। অন্যদিকে ক্ষুদ্র এবং প্রান্তিক চাষী সবুজ বিপ্লবের সুফল গ্রহণ করতে না পারায় নিঃস্ব হয়েছে।


(iii) ধণতান্ত্রিক কৃষিব্যবস্থা: কৃষিজ উৎপাদনের নতুন কৌশল পুঁজিবাদী খামার গড়ে তুলেছে। একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায় পাঞ্জাবে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ প্রান্তিক চাষী এবং এক-চতুর্থাংশ ক্ষুদ্র চাষী দারিদ্র সীমার নিচে বাস করে।


(iv) কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা: অনেকে মনে করেন কৃষিক্ষেত্রে নতুন কৃষি প্রযুক্তি প্রয়োগ করার ফলে কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে।


(v) কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের অসুবিধা: ব্যাপক মাত্রায় যান্ত্রিকীকরণের ফলে অনেক সময় দুর্ঘটনা জনিত সমস্যার সৃষ্টি হয়। সামাজিক নিরাপত্তা জনিত সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা আমাদের দেশে এখনো গড়ে ওঠেনি।


(vi) অনিয়ন্ত্রিত রাসায়নিক সারের ব্যবহার: রাসায়নিক সারের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে মৃত্তিকা ও জল দূষিত হচ্ছে এবং তার ফলে স্বাভাবিকভাবে মানুষের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা কমেছে।


(vii) পরিবেশের উপর প্রভাব: সবুজ বিপ্লবের ফলে পরিবেশের গুণগত মানের অবনমন হয়েছে। মৃত্তিকা লবনতার পরিমাণ বৃদ্ধি, জলাভূমিতে দূষণের মাত্রা বৃদ্ধির ফলে পরিবেশের উপর তার প্রভাব পড়ছে।


    উপরে উল্লেখিত অসুবিধাগুলির জন্য অনেকের সবুজ বিপ্লবকে ধূসর বিপ্লব হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতার যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে সেই সমস্যা দূর করে চিরসবুজ বিপ্লবের সূচনা করা দরকার।


সবুজ বিপ্লব প্রথম কোথায় হয়েছিল ?

উ: সবুজ বিপ্লব প্রথমে মেক্সিকোয় হয়েছিল।

সবুজ বিপ্লব কত সালে হয় ?

উ: মেক্সিকোয় সবুজ বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল 1951 সালে। 1965-66 সালে ভারতে সবুজ বিপ্লব হয়।

ভারতের সবুজ বিপ্লবের প্রধান ফসলের নাম কি?

উ: খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হলেও সবুজ বিপ্লবের মূলত গম উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।

ভারতের সবুজ বিপ্লবের প্রণেতা কে ?

উ: ড: এম এস স্বামীনাথন।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Ads Area