পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলিতে কৃষি কাজের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হলো সবুজ বিপ্লব। 1960 এর দশকে এশিয়া মহাদেশের ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ; আফ্রিকা মহাদেশের গিয়ানা, মালউই; দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের মেক্সিকো, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা প্রভৃতি দেশসমূহে উন্নতমানের বীজ, রাসায়নিক সার, জলসেচ, কীটনাশক, ভূমিসংস্কার ও ব্যাংকিং সংস্কার পরিষেবার মাধ্যমে কৃষির উন্নতি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়, যা সবুজ বিপ্লব নামে পরিচিত।
ভারতের সবুজ বিপ্লবের পূর্ব সময়কাল:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর 1947 সালে ভারত স্বাধীন হয়। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় ভারতের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এই সময় গ্রহণ করা হলেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে খাদ্য উৎপাদন সেভাবে বৃদ্ধি না পাওয়ায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় দুর্ভিক্ষ (1961সাল) দেখা দেয়। এই সমস্যার সমাধানের জন্য ভারতীয় কৃষিমন্ত্রক পৃথিবীর সবুজ বিপ্লবের জনক নরম্যান বোরলগ কে আমন্ত্রণ জানান। বোরলগ ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের কৃষি উন্নতির ধারাবাহিকতা দেখে ওই রাজ্যকেই সবুজ বিপ্লবের মূল স্থান হিসেবে চিহ্নিত করেন।
বোরলগ ভারত ত্যাগ করলে ডঃ এম এস স্বামীনাথন কৃষি বিপ্লবের এই কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যান। পরবর্তীতে তিনি ভারতের কৃষি বিপ্লবের জনক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। সম্মিলিত কর্মসূচির ফল হিসেবে 1960 এর দশকে ভারতে সবুজ বিপ্লবের সূচনা হয়।
সবুজ বিপ্লব কী?
স্বাধীনতার পরবর্তীকালে 1960 এর দশক থেকে ভারতের কৃষি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আসে। চিরাচরিত কৃষি পদ্ধতির পরিবর্তে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, সার ও উচ্চ ফলনশীল বীজের সাহায্যে যে নতুন কৃষিপদ্ধতি গড়ে তোলা হয় তাকে সবুজ বিপ্লব বলে।
১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (United States Agency for International Development, USAID) এর তৎকালীন অধিকর্তা উইলিয়াম গাউড সবুজ বিপ্লব কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন।
সবুজ বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য
(i) বিভিন্ন শস্যের, মূলত ধান ও গমের উচ্চ ফলনশীল বীজ বন্টন করা।
(ii) দার্শনিক সারের বহুল ব্যবহার।
(iii) ভূমি সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ।
(iv) জলসেচের ব্যবস্থা।
(v) গ্রামীন পরিকাঠামো উন্নয়ন।
(vi) কীটনাশকের বিপুল প্রয়োগ।
সবুজ বিপ্লবের উপাদান:
মোট 12 টি নতুন কৃষিকল কৌশল প্রয়োগ করে ভারতের সবুজ বিপ্লব ঘটানো হয়েছে। এরমধ্যে মুখ্য উপাদান চারটি। যেমন- উচ্চ ফলনশীল বীজ, জলসেচ, রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক। অপর উপাদানগুলি গৌণ উপাদান হিসেবে পরিচিত। যেমন- প্রকল্প এলাকা উন্নয়ন, জমির একত্রীকরণ, ভূমিসংস্কার, কৃষি ঋণ, গ্রামীণ বিদ্যুতায়ন, গ্রামীণ রাস্তা ও বাজার উন্নয়ন, যন্ত্রপাতি।
সবুজ বিপ্লব অঞ্চল:
উত্তর-পশ্চিম ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তর প্রদেশ, পূর্ব রাজস্থান; দক্ষিণ ভারতে অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু; পূর্ব ভারতে বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ।
সবুজ বিপ্লবের সুফল ও কুফল
সবুজ বিপ্লবের কিছু ভালো দিক থাকলেও কিছু খারাপ দিকও রয়েছে নিচে এগুলি আলোচনা করা হলো।
সুফল:
১. কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি: সবুজ বিপ্লবের প্রভাবে ভারতের সকল কৃষি দ্রব্যের উৎপাদন বিশেষ করে খাদ্যশস্য উৎপাদন অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। 1960-61 সালে ভারতে যেখানে মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল 8.2 কোটি মেট্রিক টন সেখানে 2018-19 সালে তা প্রায় 3.5 বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে 28.5 কোটি মেট্রিক টন। এই সময়কালের মধ্যে গম উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে 10 গুণ। এই কারণে সবুজ বিপ্লবকে অনেকে গম বিপ্লব বলে অভিহিত করেন।
২. কৃষকের আয় বৃদ্ধি: সবুজ বিপ্লবের ফলে বহু মানুষের নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে, রোজগার বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষিজ ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। 1960 দশকের পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে সবুজ বিপ্লবের প্রভাবে গম উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি ধান, ভুট্টা ও আলুর উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া বহু ফসলি ব্যবস্থা চালু হওয়ার জন্য বহু মানুষ সারা বছর ধরে কৃষি জমিতে কাজ পায়।
৩. খাদ্যশস্য উৎপাদনের স্বনির্ভর: সবুজ বিপ্লবের পরবর্তীকালে ভারত খাদ্যশস্য উৎপাদনে অনেকটা স্বনির্ভর হয়। 1960-61 সালে ভারতের মোট খাদ্যশস্যের 16% বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। ভারতকে বর্তমানে খাদ্যশস্য বিদেশ থেকে তেমন আমদানি করতে হয় না, বরং কিছু পরিমাণ খাদ্যশস্য বিদেশে রপ্তানি করে।
৪. কৃষি এলাকা বৃদ্ধি: বিভিন্ন শস্য চাষের এলাকাসহ কর্ষিত জমির পরিমাণ বহুগুণ বেড়েছে। 1960-61 সালে গম উৎপাদন হতো 1.3 কোটি হেক্টর জমিতে, 1917-18 সালে গম উৎপাদন হয় 2.96 কোটি হেক্টর জমিতে।
৫. শস্যাবর্তন: সবুজ বিপ্লব পরবর্তী সময়ে ভারতে ধান, গম, পশুখাদ্য, মিলেট, ভুট্টা, আখ, ডাল, তৈলবীজের শস্যাবর্তন সম্ভব হয়েছে।
৬. শিল্পের উন্নতি: সবুজ বিপ্লবের কারণে কৃষি যন্ত্রপাতি ( যেমন- ট্রাক্টর, হার্ভেস্টার, পাম্প মেশিন প্রভৃতি) সার, কীটনাশক প্রভৃতির চাহিদা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে এই সকল দ্রব্য উৎপাদনকারী শিল্পের উন্নতি ঘটে। আবার উৎপাদিত কৃষি ফসলের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন কৃষিভিত্তিক শিল্প যেমন- চালকল, চিনিকল, ময়দা কল প্রভৃতির উন্নতি ঘটে।
৭. গ্রামীন কর্মসংস্থান বৃদ্ধি: কৃষিতে অধিক যন্ত্রের ব্যবহারের কারণে প্রাথমিক অবস্থায় কর্মসঙ্কোচন ঘটলেও বহু ফসলী উৎপাদন ব্যবস্থা উন্নতির ফলে গ্রামের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছে।
৮. কৃষকের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন: সবুজ বিপ্লবের আগে অধিকাংশ কৃষক অশিক্ষিত ছিল। অশিক্ষার কারণে কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল না সবুজ বিপ্লবের কারণে গ্রামীণ শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষক আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার বিষয়গুলি সম্পর্কে জানতে পেরেছে। সামগ্রিকভাবে কৃষকের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে।
সবুজ বিপ্লবের কুফল
১. শস্য উৎপাদনে বৈষম্য: সবুজ বিপ্লবের প্রভাব সারা ভারত জুড়ে সকল ফসলের ওপর সমানভাবে পড়েনি। এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে গম ও ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে; মিলেট ও তৈল বীজের ওপর প্রভাব পড়েছে মাঝারি মাপের; ডাল জাতীয় শস্যের উপর প্রভাব খুব সামান্য। আবার কার্পাস ও পাট উৎপাদনের ওপর এর প্রভাব পড়েইনি।
২. আঞ্চলিক বৈষম্য বৃদ্ধি: সবুজ বিপ্লবের প্রভাব ভারতের মোট চাষের জমির ৪০ শতাংশের ওপর পড়েছে বাকি ৬০% এর উপর সবুজ বিপ্লবের কোন প্রভাব পড়েনি। উত্তর-পশ্চিম ভারতে পাঞ্জাব হরিয়ানা পশ্চিম উত্তর প্রদেশ দক্ষিণ ভারতের তামিললাড়ু অন্ধ্রপ্রদেশ প্রভৃতি আগে থেকে কৃষি উন্নত অঞ্চলগুলিতে সবুজ বিপ্লব রূপায়ণ করা হয় ভারতের অন্যান্য রাজ্যে এই উদ্যোগ দেখা যায়নি ফলে আঞ্চলিক বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
৩. কৃষকদের আয়ের অসাম্য: 10 হেক্টরের অধিক জমির মালিকরা উন্নত প্রযুক্তি কৃষি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে অনেক বেশি লাভবান হচ্ছে। প্রান্তিক কৃষকের জমির পরিমাণ কম থাকায় ব্যয়বহুল প্রযুক্তি নির্ভর কৃষি ব্যবস্থা কৃষি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারছে না। ফলে কৃষকদের আয়ের বৈষম্য দেখা দিয়েছে।
৪. বেকারত্ব বৃদ্ধি: সবুজ বিপ্লবের শুরুতে বহু মানুষ কর্মসংস্থান হলেও পরবর্তীকালে কৃষিতে ব্যাপক যান্ত্রিকীকরণ ঘটার কারণে শ্রম উদ্বৃত্ত থাকছে। যা ভারতের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে কর্মসংস্থানে ঘাটতি সৃষ্টি করেছে।
৫. বাস্তুতান্ত্রিক অবনমন: সবুজ বিপ্লবের অন্যতম কুফল হলো বাস্তুতান্ত্রিক অবনমন যা ভারতীয় কৃষিকে ভয়ংকর সমস্যায় ফেলেছে।
৬. লবনতা বৃদ্ধি: পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তর প্রদেশে সারাবছর ধরে অতিরিক্ত জলসেচের ফলে প্রায় 50% এলাকার মাটি লবণাক্ত বা ক্ষারধর্মী হয়ে পড়েছে।
৭. ভূগর্ভস্থ জলের অবনমন: সারাবছর ধরে কূপ-নলকূপ থেকে বিপুল পরিমাণ ভৌমজল উত্তোলনের ফলে পশ্চিম ভারতের মাটির জলতল দ্রুত নেমে যাচ্ছে। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের দ্বারা ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
৮. কৃষকের মধ্যে বিভ্রান্তি: BT তুলো বীজের মতো বিষয়গুলি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। এগুলো চাষ করে সার, জল ইত্যাদি যথেষ্ট পরিমাণে প্রয়োগ করতে হয়।
৯. দূষণ: সবুজ বিপ্লবের ফলে জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগ বহুগুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাপক মৃত্তিকা দূষণ ঘটে। আবার জমির জল উপচে পাশের জলাশয়ে পড়ে জলদূষণ ঘটে।
সবুজ বিপ্লবের ফলে যে সকল সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে সেগুলির সমাধানের কিছু উপায় রয়েছে। যেমন-
(i) কৃষকদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করার জন্য উপযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা।
(ii) উন্নত জলসেচ ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
(iii) উন্নত ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করা, যার সাহায্যে কৃষকরা সহজে আর্থিক সুবিধা নিতে পারে।।
(iv) কৃষি ক্ষেত্রে সঙ্গে শিল্প এবং বাজারের মধ্যে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
(v) রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সারের ব্যবহার বৃদ্ধি করা।
প্রথম সবুজ বিপ্লব রূপায়ন করার জন্য তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকালে ভারত সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। এর ফলশ্রুতি হিসেবে 1965-66 সালে ভারতের সবুজ বিপ্লবের বাস্তব রূপায়ণ সম্ভব হয়। পরবর্তীতে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সবুজ বিপ্লবের প্রভাব পড়তে দেখা যায়। ফলশ্রুতি হিসাবে 2004 থেকে 2006 সালের মধ্যে দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লব ভারতের রূপায়িত হয়।
ভারতের সবুজ বিপ্লবের জনক কে ?
উ: ডঃ এম এস স্বামীনাথন।
সবুজ বিপ্লবের জনক কে ?
উ: নরম্যান বোরলগ কে সবুজ বিপ্লবের জনক বলে।
সবুজ বিপ্লব কথাটি প্রথম কে ব্যবহার করেন ?
উ: ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (USAID) এর তৎকালীন অধিকর্তা উইলিয়াম গাউড সবুজ বিপ্লব কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন।
সবুজ বিপ্লব কোন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় হয়েছিল?
উ: তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকালে ( 1961-66) হয়েছিল।
সবুজ বিপ্লব হয়েছিল কোন কৃষি উৎপাদনে ?
উ: খাদ্যশস্য মূলত ধান ও গম।