Type Here to Get Search Results !

যান্ত্রিক আবহবিকার

  ‘আবহবিকার' শব্দটি আবহাওয়া থেকে এসেছে। কাজেই আবহবিকার বলতে আমরা বুঝি আবহাওয়ার দ্বারা ভূপৃষ্ঠের পরিবর্তন সাধন। বিখ্যাত ভূ-বিজ্ঞানী ডব্লু. ডি. থর্নবেরি বলেছেন, “আবহবিকার হল কোনো শিলার নিজস্থানে বিচূর্ণন বা বিয়োজন”। সুতরাং আরো বিস্তারিতভাবে বলা যায়, আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদানের প্রভাবে ভূপৃষ্ঠের শিলার উপরিভাগে যে বিচূর্ণীভবন এবং বিয়োজন হয় তাকেই আবহবিকার বলে। এর ফলে শিলাসমূহের উপরিভাগ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে মূল শিলা থেকে বিয়োজিত হয়ে সেখানেই অবস্থান করে। যেমন লোহায় মরচে ধরা।


আবহবিকারের শ্রেণীবিভাগ:

আবহবিকার দু'টি ভিন্ন পদ্ধতিতে সংঘটিত হয় বলে একে দু'টি প্রধান শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যথা – (ক) যান্ত্রিক আবহবিকার এবং (খ) রাসায়নিক আবহবিকার।

এছাড়া উদ্ভিদ ও প্রাণী, যান্ত্রিক ও রাসায়নিক পদ্ধতিতে শিলার আবহবিকার ঘটায় বলে একে (গ) জৈব আবহবিকার বলে।


(ক) যান্ত্রিক আবহবিকার কাকে বলে?

যান্ত্রিক আবহবিকারঃ নানাপ্রকার প্রাকৃতিক শক্তি, যেমন - উত্তাপ, বৃষ্টিপাত, বাতাস, নদী, তুষার, হিমবাহ প্রভৃতির দ্বারা চাপের হ্রাস-বৃদ্ধির ফলে ভূপৃষ্ঠের উপরের শিলা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ছোট ছোট শিলাখণ্ডে পরিণত হয়ে মূল শিলার উপর অবস্থান করে, তখন তাকে যান্ত্রিক আবহবিকার বলে।

যান্ত্রিক আবহবিকারের উপযোগী জলবায়ু: যান্ত্রিক আবহবিকার প্রধানত (১) উষ্ণ মরু অঞ্চল, (২) মেরু অঞ্চল এবং (৩) গ্রীষ্মপ্রধান ও শীতপ্রধান নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়।

(১) উষ্ণ মরু অঞ্চল: উষ্ণ মরু অঞ্চলে দিনের বেলায় উত্তাপ বেশি ও রাত্রে উত্তাপ কম অনুভূত হয়। কাজেই দিনের উত্তাপে শিলা প্রসারিত ও রাত্রের শৈত্যে শিলা সঙ্কুচিত হয়। ক্রমাগত প্রসারিত ও সঙ্কুচিত হওয়ার ফলে শিলা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। সুতরাং এইরূপ উষ্ণ জলবায়ু অঞ্চলে যান্ত্রিক আবহবিকার প্রাধান্য লাভ করে।


(২) মেরু অঞ্চলঃ বরফাবৃত মেরু অঞ্চলে পর্বতে অনেক ফাটল থাকে। এই অঞ্চলে তুষারের কেলাসন প্রক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। কাজেই এখানে যান্ত্রিক আবহবিকার পরিলক্ষিত হয়।


(৩) গ্রীষ্মপ্রধান ও শীতপ্রধান নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলঃ এই জলবায়ুযুক্ত অঞ্চলে বৃষ্টি ও তুয়ারপাত দেখতে পাওয়া যায়। কাজেই শীতপ্রধান নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে যান্ত্রিক আবহবিকার পরিলক্ষিত হয়। গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে অত্যধিক উষ্ণতার জন্য শিলার প্রসারণ ঘটে এবং শিলা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়। শীতপ্রধান নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে কেলাসন প্রক্রিয়ার প্রাধান্যও দেখা যায়।


যান্ত্রিক আবহবিকারের প্রক্রিয়া

প্রধানত ছয়টি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যান্ত্রিক আবহবিকার সংঘটিত হয়। যথা-

(১) উষ্ণতার পার্থক্য, (২) কেলাসন প্রক্রিয়া, (৩) বৃষ্টিপাতের ফলে, (৪) শিলাস্তরে চাপ হ্রাসের ফলে, (৫) উদ্ভিদ ও প্রাণীর দ্বারা এবং (৬) কলয়েডীয় উৎপাটন দ্বারা। 

উপরে বর্ণিত প্রক্রিয়াগুলির ফলে যান্ত্রিক আবহবিকারের দ্বারা শিলার কোনো রাসায়নিক বিয়োজন ঘটে না। কেবলমাত্র আকৃতিগত পরিবর্তন হয়। কাজেই যান্ত্রিক আবহবিকারের ফলে শিলাসমূহ তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারায় না। শুধু ছোট ছোট অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। উষ্ণ মরু অঞ্চল এবং সুউচ্চ পর্বতগাত্রে যান্ত্রিক আবহবিকারের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়।


যান্ত্রিক আবহবিকারের প্রক্রিয়াগুলি নিচে আলোচনা করা হল- 


(১) উষ্ণতার পার্থক্যের ফলে:

উষ্ণ মরু অঞ্চলে উষ্ণতার পার্থক্য সব চেয়ে বেশি। দিনেরবেলা প্রচণ্ড উত্তাপ ও রাত্রিবেলা প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। এই কারণে মরু অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি যান্ত্রিক আবহবিকারের প্রাধান্য দেখতে পাওয়া যায়। এই মরু অঞ্চলে উষ্ণতার পার্থক্যের ফলে (১) প্রস্তর চাই বিচ্ছিন্নকরণ, (২) শল্কমোচন এবং (৩) ক্ষুদ্রকণা বিসরণের মাধ্যমে যান্ত্রিক আবহবিকার ঘটে থাকে।


(i) প্রস্তর চাই বিচ্ছিন্নকরণ:  মরু অঞ্চলে দিনেরবেলায় প্রচণ্ড উত্তাপের ফলে শিলার উপরিভাগ প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়ে প্রসারিত হয়ে যায়। কিন্তু শিলার নিচের অংশ ততটা প্রসারিত হয় না। ফলে শিলার উপরের স্তর ও নিচের স্তরের মধ্যে পীড়নের সৃষ্টি হয় এবং শিলাস্তর দু'টির মাঝের অংশে ফাটলের সৃষ্টি করে। পরবর্তী সময়ে উপরের শিলাস্তর মূল শিলা থেকে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। একেই প্রস্তর চাই বিচ্ছিন্নকরণ বলে।



(ii) শল্কমোচন: শল্কমোচন যান্ত্রিক আবহবিকারের তাপীয় প্রসারণের একটি উল্লেখযোগ্য প্রক্রিয়া। সমপ্রকৃতির শিলার উপরের স্তর ভেতরের স্তরের চেয়ে অনেক বেশি উত্তপ্ত হয়ে আয়তনে বৃদ্ধি পেলে তা পেয়াজের খোসার মতো ধীরে ধীরে খুলে যায়। এরূপ অবস্থাকে শল্কমোচন বা এক্সফোলিয়েশন বলে। এর ফলে এ জাতীয় শিলার উপরিভাগ স্তরে স্তরে খুলে গিয়ে গোলাকৃতি ভূমিরূপের সৃষ্টি করে।


(iii) ক্ষুদ্রকণা বিসরণ: সাধারণত কয়েকটি খনিজ পদার্থের সমন্বয়ে শিলা গঠিত হয় বলে প্রতিটি খনিজ পদার্থের মধ্যে অবস্থিত যোগসূত্র বন্ধ দ্বারা তারা একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকে। কিন্তু যান্ত্রিক আবহবিকারে উষ্ণতার প্রভাবে শিলা ফেটে গেলে বিভিন্ন খনিজের মধ্যে অবস্থিত যোগসূত্র বস্তু ফেটে যায়। ফলে মরু অঞ্চলের প্রস্তরখণ্ডগুলি ভেঙে গিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণায় পরিণত হয়। একে ক্ষুদ্রকণা বিসরণ বা কণাভবন বলে।


(২) কেলাসন প্রক্রিয়ার ফলে : 

উচ্চ অক্ষাংশে, সুউচ্চ পর্বতগাত্রে, শীতল জলবায়ু অঞ্চলে বর্ষাকালে বর্ষার জল ফাটলের মধ্যে জমা হয়। পরে শীতকালে ঐ জল বরফে পরিণত হয়ে আয়তনে বৃদ্ধি পায় এবং ফাটলে চাপ দিয়ে শিলাস্তরকে ফাটিয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে। একে কেলাসন প্রক্রিয়া বলে।


(৩) বৃষ্টিপাতের ফলে: 

বৃষ্টিবহুল অঞ্চলে বৃষ্টির জল ভূপৃষ্ঠের উপর পতিত হলে কোমল শিলাস্তরকে আর্দ্র করে তোলে, ফলে ঐ শিলা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়। আবার যে সকল অঞ্চলের উপর দিয়ে নদী প্রবাহিত হয়, সেইসব অঞ্চলে জলপ্রবাহের মধ্যবর্তী বায়ুর চাপের ফলে নদীর নিম্নবর্তী শিলাস্তর ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যান্ত্রিক আবহবিকারের সৃষ্টি করে।


(৪) শিলাস্তরে চাপ হ্রাসের ফলে : 

ভূপৃষ্ঠের উপরের শিলাস্তরে আবহবিকারের ফলে উপরের শিলা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে নানাপ্রকার প্রাকৃতিক শক্তির দ্বারা অপসারিত হয়। তখন উপরের শিলাস্তরের চাপ হ্রাস পায়। ফলে তখন নিচের শিলাস্তরগুলির চাপ হ্রাসের ফলে প্রসারিত হয়ে ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে বিভিন্ন আকারের ফাটলের সৃষ্টি করে। পরবর্তীকালে বড় বড় শিলাস্তরগুলি ঐ ফাটলের প্রভাবে একে-অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এভাবে যান্ত্রিক আবহবিকার ঘটে।


(৫) উদ্ভিদ ও প্রাণীর দ্বারা: 

শিলাস্তরের উপর কোনো গাছপালা জন্মালে ঐ গাছপালার শিকড় শিলার মধ্যস্থিত ফাটলের মধ্যে প্রবেশ করে শিলাস্তরকে ফাটিয়ে দেয়। এর ফলে শিলা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে মূল শিলাস্তর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

আবার কেঁচো, ছুঁচো, ইঁদুর, খরগোশ, প্রেইরি কুকুর ইত্যাদি প্রাণী এবং নানাপ্রকার কীটপতঙ্গ শিলার উপর গর্ত খুঁড়ে শিলার জৈব যান্ত্রিক আবহবিকারে সাহায্য করে।


(৬) কলয়েডীয় উৎপাটন দ্বারা :

মৃত্তিকার একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উপাদান হল ‘কলয়েড। কলয়েড এক প্রকার জৈব ও খনিজের সমন্বয়ে গঠিত আঠালো পদার্থ। এই কলয়েড যখন শুকনো বা শুকিয়ে যায়, তখন শিলাস্তরের উপরের অংশ খসে পড়ে যান্ত্রিক আবহবিকার ঘটতে সাহায্য করে।


মরুভূমি ও মরুপ্রায় অঞ্চলে যান্ত্রিক আবহবিকার বেশি হয় কেন?

তাপের আকস্মিক পরিবর্তন ও অন্যান্য প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে শিলাসমূহ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যখন মূল শিলার ওপর অবস্থান করে, তখন তাকে যান্ত্রিক আবহবিকার বলে। 

[i] থর ও অন্যান্য মরু ও মরুপ্রায় অঞ্চলে দিন-রাত্রির উষ্ণতার পার্থক্য বেশি হয় বলে তাপের দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। 

[ii] এর ফলে ঐ অঞ্চলের শিলাসমূহের সঙ্কোচন ও প্রসারণ অধিক ঘটে। 

[iii] শিলাসমূহ তাপের কুপরিবাহী হওয়ায় শিলার উপরের স্তর ও নিচের স্তরের মধ্যে অসম পীড়নের সৃষ্টি হয়। 

[iv] অনেক সময় বিষমসত্ত্ব শিলা অধিক উত্তাপে বা ঠাণ্ডায় সমানভাবে প্রসারিত বা সঙ্কুচিত হতে পারে না। ফলে শিলার মধ্যে অসম টানের সৃষ্টি হয়। 

[v] প্রস্তর চাঁই বিচ্ছিন্নকরণ, ক্ষুদ্রকণা বিসরণ প্রভৃতি পদ্ধতিতে তাই শিলা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এই কারণে বলা হয় যে থর ও অন্যান্য মরুভূমি ও মরুপ্রায় অঞ্চলে যান্ত্রিক আবহবিকার বেশি সংঘটিত হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Ads Area