অঞ্চল কাকে বলে ?
সাধারণ মানুষের কাছে অঞ্চল বলতে বোঝায় বিশেষ গুণাবলী সম্পন্ন বিশেষ আয়তনের একটি ভৌগোলিক এলাকা, যা দিয়ে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য সাধন করা যায়। ভৌগলিকদের কাছে অঞ্চল শব্দটির অন্য একটি তাৎপর্য রয়েছে।
ভূগোলের ভাষায়- অঞ্চল হল একবার একাধিক সমধর্মী গুণবিশিষ্ট দৈশিক একক।
সমধর্মিক গুণ বা বৈশিষ্ট্যগুলি প্রাকৃতিক বা সামাজিক দুই ধরনের হতে পারে। যেমন- জলবায়ু, ভূপ্রকৃতি প্রভৃতি প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এর ভিত্তিতে অঞ্চল চিহ্নিত করা হয়। তেমনি শিল্প উৎপাদন, কৃষিকাজ, জনবন্টন, বাণিজ্য এদের ভিত্তিতেও অঞ্চল চিহ্নিত করা যেতে পারে। সমধর্মিতা বলতে এখানে বৈচিত্রের অভাব বোঝানো হয় না। গুনগুলি একটি অঞ্চল থেকে অপরটিকে আলাদা করে।
অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য:
i.অঞ্চল সমধর্মী গুণবিশিষ্ট হবে অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের কিছু এলাকা জুড়ে প্রাকৃতিক এবং মানবিক উপাদানগুলির সমরূপতা অথবা সমধর্মিতা লক্ষ্য করা যাবে।
ii. অঞ্চল পৃথক সত্ত্বা বিশিষ্ট।
iii. অঞ্চল কতগুলি এলাকার সমন্বয়ে গঠিত হবে।
iv. ভূপৃষ্ঠের নির্দিষ্ট স্থান জুড়ে অবস্থান করবে।
v. একটি অঞ্চল অপর অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যযুক্ত হবে।
vi. অঞ্চলের নির্দিষ্ট প্রশাসন থাকে।
অঞ্চলের উপাদান: একটি অঞ্চলের কতগুলি উপাদান বা বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন-
১. প্রত্যেকটি অঞ্চলের একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রমান থাকতে হবে। অন্যভাবে বলা যায় অঞ্চলগুলি ভূপৃষ্ঠে নির্দিষ্ট জায়গা জুড়ে অবস্থান করবে।
২. বিভিন্ন প্রাকৃতিক এবং মানবিক উপাদান থাকতে হবে। প্রাকৃতিক উপাদান যেমন- ভূপ্রকৃতি, নদনদী, জলবায়ু; মানবিক উপাদান যেমন- জনসংখ্যা, শিক্ষা, সংস্কৃতি থাকতে হবে।
৩. অঞ্চলের নির্দিষ্ট অবস্থান থাকতে হবে।
৪. অঞ্চলটি নির্দিষ্ট সীমারেখা দ্বারা চিহ্নিত থাকবে।
৫. অঞ্চলের মধ্যে কোন বিষয়ের বা বিষয়গুলির মধ্যেকার সমন্বয়ের সমতার ভিত্তিতে সীমারেখা টানা হয়।।
৬. বিভিন্ন বিষয়ের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে অঞ্চলকে একটি পৃথক সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করে।
অঞ্চলের শ্রেণীবিভাগ:
ক. উপাদান বা বৈশিষ্ট্যের সংখ্যার ভিত্তিতে অঞ্চল তিন প্রকার। যথা- a. একটিমাত্র উপাদান ভিত্তিক অঞ্চল (ভূ প্রাকৃতিক অঞ্চল, স্বাভাবিক উদ্ভিদ অঞ্চল) b. একাধিক একাধিক উপাদান ভিত্তিক অঞ্চল(জলবায়ু অঞ্চল, সামাজিক অঞ্চল) c. সামগ্রিক অঞ্চল বা কমপেজ।
খ. অভ্যন্তরীণ গঠনের ভিত্তিতে অঞ্চলকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- a. বাহ্যিক অঞ্চল b. কার্যকরী বা ক্রিয়ামূলক অঞ্চল।
বিভিন্ন প্রকার অঞ্চল:
প্রাকৃতিক অঞ্চল: পৃথিবীর যে নির্দিষ্ট অঞ্চলে উষ্ণতা, বৃষ্টিপাত, মৃত্তিকা, ভূ-প্রকৃতি প্রভৃতির ওপর নির্ভর করে যে উদ্ভিদ এবং প্রাণী গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছে এবং মানুষের ক্রিয়াকলাপ প্রায় সমধর্মী সেই নির্দিষ্ট এলাকাকে প্রাকৃতিক অঞ্চল বলে।
বৈশিষ্ট্য
i. প্রাকৃতিক অঞ্চল সমধর্মী হয়।
ii. এই অঞ্চল জলবায়ু অঞ্চলের এক রূপ।
iii. এই অঞ্চলের নির্দিষ্ট কোন সীমারেখা নেই।
iv. একটি দেশে একাধিক প্রাকৃতিক অঞ্চল থাকতে পারে।
v. একটি প্রাকৃতিক অঞ্চল একাধিক দেশের মধ্যে থাকতে পারে।
vi. একটি প্রাকৃতিক অঞ্চলের মধ্যে উপপ্রাকৃতিক অঞ্চল থাকে।
শিল্প অঞ্চল: যখন কোন একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক এলাকায় একদেশীভবনের কারণে বিভিন্ন প্রধান, গৌণ, সহযোগী ও প্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পের একত্র সমাবেশ দেখা যায়, তখন একাধিক শিল্পযুক্ত অঞ্চলকে শিল্প অঞ্চল বলে।
বৈশিষ্ট্য
i. এই অঞ্চলের শিল্পের পরিকাঠামো থাকে।
ii. অঞ্চলটি অর্থনৈতিক দিক থেকে উন্নত এবং সমৃদ্ধ।
iii. যোগাযোগ ব্যবস্থার কেন্দ্রে গড়ে ওঠে।
ভাষা অঞ্চল: মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ এবং বিনিময় করে যার মাধ্যমে তাকে ভাষা বলে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষ বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। ভারতে প্রায় 225 টির বেশি ভাষা আছে। যখন কোন একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষ একটি নির্দিষ্ট ভাষায় কথা বলে তখন ওই ভাষাভাষী যুক্ত এলাকাতে ভাষা অঞ্চল বলে। যেমন- ইন্দো-ইউরোপিয়ান, অস্ট্রো-এশিয়াটিক, ইন্দো-ইরানিয়ান প্রভৃতি প্রধান ভাষায় অঞ্চল।
বৈশিষ্ট্য
i. একটি প্রধান ভাষা অঞ্চলের মধ্যে বিভিন্ন উপভাষা অঞ্চল তৈরি হয়।
ii. একই ভাষা অঞ্চলের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঐক্য বজায় থাকে।
iii. ভাষা অঞ্চল কোন রাজনৈতিক সীমায় আবদ্ধ থাকে না।
iv. ভাষা অঞ্চল রাজনৈতিক স্বায়ত্ব শাসনের ইচ্ছাকে প্রকট করে।
সাংস্কৃতিক অঞ্চল: যে নির্দিষ্ট অঞ্চলে মানুষের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ভাষা, রুচি ও জীবনযাপনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় সমধর্মি হয়, সেই অঞ্চলকে এক সাংস্কৃতিক অঞ্চল বলে।
বৈশিষ্ট্য
i. একটি নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক অঞ্চলের সমধর্মী চিন্তা, রুচির, সামাজিক অবস্থান প্রতিফলিত হয়।
ii. সুস্থ সাংস্কৃতিক অঞ্চল থেকে উন্নত সমাজের বিকাশ ঘটে।
iii. বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনি শক্তির বিকাশ ঘটে।
iv. দুটি সাংস্কৃতিক অঞ্চলের মধ্যবর্তী স্থানে মিশ্র সংস্কৃতি দেখা যায়।
v. সাংস্কৃতিক অঞ্চল কোন সীমারেখা দ্বারা আবদ্ধ থাকতে পারে না।
সামাজিক অঞ্চল: সামাজিক পদ্ধতিতে উৎপাদন ব্যবস্থা, লভ্যাংশ, বন্টন, ভোগ এদের সঙ্গে সামাজিক স্থিতি ও সংস্কৃতি, মানবিক উপাদান ও আর্থসামাজিক মেটাল পদ্ধতির দ্বারা সামাজিক অঞ্চল নির্ধারণ করা হয়।
গ্রন্থি অঞ্চল: গ্রন্থি অঞ্চল বলতে ক্রিয়ামূলক অঞ্চলকে বোঝায়। কোন অঞ্চলকে যে সমধর্মী হতেই হবে সেটা ঠিক নয়। অনেক প্রকার বৈশিষ্ট্য নিয়ে গড়ে উঠবে একটি গ্রন্থি অঞ্চল। যার মধ্যে সকল বৈশিষ্ট্যগুলি একসঙ্গে সামগ্রিকভাবে ক্রিয়া করবে।
বাহ্যিক অঞ্চল: এক বা একাধিক সমধর্মী গুণবিশিষ্ট দৈশিক একককে বাহ্যিক অঞ্চল বলে। এই ধরনের অঞ্চল নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে প্রাকৃতিক বিষয়গুলি যেমন- ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, মৃত্তিকা, স্বাভাবিক উদ্ভিদ প্রভৃতির সমধর্মিতাকে বিবেচনা করা হত। তবে পরবর্তীকালে অর্থনৈতিক, যেমন- শিল্প, কৃষি, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সমধর্মিতাকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়।
বৈশিষ্ট্য
i. বাহ্যিক অঞ্চলের মধ্যে সর্বত্র একই বৈশিষ্ট্য সমানভাবে বিরাজ করে।
ii. বাহ্যিক অঞ্চলে বৈশিষ্ট্যগুলি পরস্পর সংলগ্ন।
iii. এদের একটির সীমানা অপর অঞ্চলের সীমানা পেরিয়ে যেতে পারে না।
iv. বিভিন্ন সমধর্মী বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে এই অঞ্চল চিহ্নিত করা হয়।
উদাহরণ: যেমন- কাশ্মীর অঞ্চল, সুন্দরবন।
ক্রিয়ামূলক অঞ্চল: যখন আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মধ্যে একটি ক্রিয়ামূলক সংহতি এবং পারস্পরিক নির্ভরতার ভিত্তিতে অঞ্চলকে পৃথক করা হয়, তখন তাকে ক্রিয়ামূলক অঞ্চল বলে।
বৈশিষ্ট্য:
i. ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির হলেও একসঙ্গে সামগ্রিকভাবে কাজ করে।
ii. অঞ্চলগুলি পরস্পরের প্রতি কিছুটা নির্ভরশীল।
iii. ক্রিয়ামূলক অঞ্চলের বিভিন্ন অংশ একসঙ্গে কাজ করে।
সহযোগী অঞ্চল: ভৌগোলিক আলোচনায় অঞ্চল কিভাবে চিহ্নিত হবে তা নিয়ে ভৌগোলিকরা দ্বিমত হন। কোন অঞ্চল বাহ্যিক না ক্রিয়ামূলক এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে কিছু ভৌগোলিক বললেন একটি পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ারত পূর্ণাঙ্গ অঞ্চল হল সহযোগী অঞ্চল।
পরিকল্পনা অঞ্চল: ভৌগোলিক গ্ল্যাসন-এর দেওয়া সংজ্ঞা অনুসারে, প্ল্যানিং রিজিয়ন অর্থাৎ পরিকল্পনা অঞ্চল হল এমন এক ধরনের বিশেষ ক্ষেত্র, যেখানে প্রাকৃতিক এবং মানবীয় কোনো এক বা একাধিক সমস্যার সমাধানের প্রয়োজন আছে এবং ওই সমস্যার ভৌগোলিক ব্যাপ্তি অনুসারে সেই ক্ষেত্রটিকে অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত করা সম্ভব। যেমন— বন্যা নিবারণ, ভূমিক্ষয় রোধ, অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা নিবারণ এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের উদ্দেশ্যে সৃষ্ট দামোদর নদী-উপত্যকা পরিকল্পনা অঞ্চল।
বৈশিষ্ট্য
(i) কোনো পরিকল্পনা অঞ্চল আয়তনে খুব বড়ো বা ছোটো হবে না।
(ii) পরিকল্পনা অঞ্চলের সীমানা প্রয়োজন অনুযায়ী পুনঃনির্ধারণ করা যাবে।
(iii) এই অঞ্চল আকৃতিগতভাবে সুসংহত হবে।
(iv) অঞ্চলটির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এবং পারস্পরিক আকর্ষণ থাকবে।
(v) আলোচ্য অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং ক্রিয়ামূলক ঐক্য থাকবে।
(vi) পরিকল্পনা অঞ্চলের সমস্যা ওই অঞ্চলের মধ্যে সর্বত্র সমধর্মী হবে।
(vii) পরিকল্পনা অঞ্চলটিকে প্রশাসনিক পরিসেবা দেওয়ার উপযুক্ত হতে হবে।
পরিকল্পনা অঞ্চলের শ্রেণি: পরিকল্পনা অঞ্চলের তিনটি ক্রম। যথা- বৃহৎ অঞ্চল, মাঝারি অঞ্চল, ক্ষুদ্র অঞ্চল। ( বিস্তারিত বিবরণের জন্য ➨ Click )