নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাত
নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাত কাকে বলে?
উভয় গোলার্ধে 30° থেকে 65° অক্ষরেখার মধ্যে দুটি বিপরীতধর্মী বায়ুপ্রবাহ (উষ্ণ এবং শীতল) পরস্পর বিপরীত দিকে বা মুখোমুখি প্রবাহিত হওয়ার ফলে যে ঘূর্ণবাতের সৃষ্টি হয় তাকে মধ্য অক্ষাংশীয় ঘূর্ণবাত বলে।
পৃথিবীর তাপমন্ডল অনুসারে এই ঘূর্ণবাত নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলে সৃষ্টি হয় বলে একে নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাত বলা হয়। ক্রান্তীয় অঞ্চলের বাইরের সৃষ্টি হয় বলে একে বহি:ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত (Extra Tropical Cyclone) বলা হয়।
নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাত |
নাতিশীতোষ্ণ বা মধ্য অক্ষাংশ ঘূর্ণবাতের বৈশিষ্ট্য
১. এই ঘূর্ণবাতে উষ্ণ এবং শীতল বায়ু পরস্পর বিপরীত দিক থেকে প্রবাহিত হওয়ার ফলে সৃষ্টি হয়।
২. উষ্ণ বায়ু হালকা হওয়ায় উপরের দিকে উঠে এবং শীতল বায়ু ভারী হওয়ায় নিচের দিকে নামে।
৩. উষ্ণ এবং শীতল বায়ু এই ঘূর্ণবাতে সীমান্ত বরাবর মিলিত হয়।
৪. এই ঘূর্ণবাত বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে অবস্থান করে।
৫. ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের মতো ঝড়ের গতি খুব বেশি হয় না।
৬. কিছুদিন বৃষ্টিপাত হয়।
৭. সাধারণত শীতকালে এই ঘূর্ণবাত বেশি সৃষ্টি হয়।
৮. সমুদ্র এবং স্থলভাগ উভয় স্থানে এই ঘূর্ণবাত দেখা যায়।
নাতিশীতোষ্ণ বা মধ্য অক্ষাংশ ঘূর্ণবাত জীবনচক্র
মধ্য অক্ষাংশের নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে(30°-65°অক্ষাংশ) সৃষ্ট ঘূর্ণবাতকে নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাত বলে। এই ঘূর্ণবাতের জীবনচক্রকে নরওয়ের আবহাওয়াবিদ ভি. বার্কনেস, জে. বার্কনেস এবং এইচ সোলবার্গ ছয়টি পর্যায়ে বিভক্ত করে আলোচনা করেছেন। তাদের এই মতবাদকে মেরু সীমান্ত তত্ত্ব বলা হয়।
নিচে এই ঘূর্ণবাতের বিভিন্ন পর্যায় সম্পর্কে আলোচনা করা হলো,-
প্রথম পর্যায়
মেরু অঞ্চল থেকে আগত শীতল, শুষ্ক ও ভারী মেরু বায়ু এবং ক্রান্তীয় অঞ্চল থেকে আগত উষ্ণ, হালকা এবং আর্দ্র পশ্চিমা বায়ু পরস্পর মুখোমুখি হয়। মেরু বায়ু পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হয় এবং পশ্চিমা বায়ু পশ্চিম থেকে পূর্বে প্রবাহিত হয়। এই বায়ু দুটি পরস্পর সমান্তরালে বা পাশাপাশি প্রবাহিত হয়। উভয় প্রকার বায়ুর মাঝে এক বিচ্ছেদ তলের সৃষ্টি হয় যাকে সাম্য সীমান্ত বলে।
দ্বিতীয় পর্যায়
এই পর্যায়ে শীতল বায়ু দিক পরিবর্তন করে উত্তর থেকে দক্ষিনে উষ্ণ বায়ুপুঞ্জের মধ্যে প্রবেশ করে এবং শীতল সীমান্ত গঠন করে। উষ্ণ বায়ু সংকুচিত হয় এবং দিক পরিবর্তন করে দক্ষিণ থেকে উত্তরে শীতল বায়ুর মধ্যে প্রবেশ করার চেষ্টা করে এবং উষ্ণ সীমান্ত গঠন করে। উষ্ণ ও শীতল সীমান্ত যে বিন্দুতে মিলিত হয় তাকে তরঙ্গ শীর্ষ বলা হয়।
তৃতীয় পর্যায় ( বাত তরঙ্গের বিকাশ )
এই পর্যায়ে সীমান্তের বক্রতা বৃদ্ধি পায় শীতল বায়ু অধিক শক্তিশালী বা সক্রিয় হওয়ায় বলপূর্বক উষ্ণ বায়ুর মধ্যে প্রবেশ করে। ফলে উষ্ণ সীমান্ত সংকীর্ণ হয় এবং শীতল সীমান্ত ক্রমশ প্রশস্ত হতে থাকে।
চতুর্থ পর্যায়
এই পর্যায়ে শীতল বাতাস মাটি ঘেঁষে অগ্রসর হয়ে উষ্ণ বাতাসকে দ্রুত সরিয়ে দিতে থাকে। কিন্তু উষ্ণ বাতাস শীতল বাতাসকে ঠেলে দ্রুত অগ্রসর হতে পারে না ফলে উষ্ণ বাতাস দ্রুত উপরে উঠতে থাকে এবং ঘনীভূত হয়ে মেঘ ও বৃষ্টিপাত সৃষ্টি করে। এই পর্যায়ে সীমান্তের বক্রতা সবচেয়ে বেশি হয় এবং ঘূর্ণবাতটি পরিপূর্ণ হতে থাকে।
পঞ্চম পর্যায়
শীতল সীমান্ত উষ্ণ সীমান্তের দিকে দ্রুত বেগে এগিয়ে গিয়ে অনায়াসে একটি বক্র সীমান্ত বরাবর উষ্ণ সীমান্তের সঙ্গে মিলিত হয় এবং একটি মাত্র সীমান্ত গঠন করে। এই ধরনের সীমান্তকে অক্লুডেড সীমান্ত বা অবরুদ্ধ সীমান্ত বলে। উষ্ণ বায়ু পুঞ্জের কিছু অংশ ভূপৃষ্ঠ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অনেক উপরে শীতল বায়ুর মধ্যে অবস্থান করে। উষ্ণ বায়ুর চাপ কম থাকায় এই উষ্ণ বায়ু ঘূর্ণবাতের কেন্দ্র রূপে অবস্থান করে।
ষষ্ঠ পর্যায়
শীতল বায়ু দ্বারা বেষ্টিত থাকায় উষ্ণ বায়ুর উষ্ণতা এবং জলীয় বাষ্পের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। বায়ুটি একসময় শীতল বায়ুর সঙ্গে মিশে যায়। ফলে ঘূর্ণবাত ক্রমশ দুর্বল হয় এবং একসময় ঘূর্ণবাতটির মৃত্যু হয়। এরপর উষ্ণ ও শীতল বায়ু স্বাভাবিকভাবে বইতে শুরু করে।
ব্যারোক্লিনিক অবস্থা বলতে কি বোঝ?
বায়ুর সমোষ্ণ তল বা সমঘনত্ব পৃষ্ঠ (Equal density surface) এবং সমচাপ পৃষ্ঠ (Isobaric surface) বা সমচাপতল যদি ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে অবস্থান না করে পরস্পর তির্যকভাবে বা উলম্বভাবে ছেদ করে তখন তাকে ব্যারোক্লিনিক অবস্থা বলে।
এইরকম অবস্থার সৃষ্টি হলে তাপমাত্রার পার্থক্য জনিত কারণে বায়ুর গতিবেগ বৃদ্ধি পায় এবং নিচের বাতাস ক্রমশ উপরের দিকে উঠে যায়। চারপাশের বাতাস শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য ছুটে আসার ফলে ঘূর্ণবাতের সৃষ্টি হয়।
ব্যারোট্রপিক অবস্থা কি?
বায়ুর সমচাপ পৃষ্ঠ (Isobaric surface) বা সমচাপতল এবং সমোষ্ণ তল বা সমঘনত্ব পৃষ্ঠ (Equal density surface) পরস্পর সমান্তরালে অবস্থান করলে তাকে ব্যারোট্রপিক অবস্থা বলে।