Type Here to Get Search Results !

জলবায়ু এবং স্বাভাবিক উদ্ভিদ (Climate and Natural Vegetation)

 স্বাভাবিক উদ্ভিদ কাকে বলে?

         মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই যে সকল উদ্ভিদ কোন অঞ্চলের জলবায়ু, মাটি ও ভূ-প্রকৃতির প্রভাবে নিজে নিজে জন্মায় ও বড় হয়, তাদের স্বাভাবিক উদ্ভিদ বলে।

স্বাভাবিক উদ্ভিদের বিকাশে জলবায়ুর ভূমিকা 

          স্বাভাবিক উদ্ভিদের জন্ম, বৃদ্ধি, বিকাশ এবং বন্টনে জলবায়ু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জলবায়ুর যে সকল উপাদানগুলি উদ্ভিদের বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেগুলি হল- সূর্যালোক, উষ্ণতা, অধ:ক্ষেপণ, আর্দ্রতা, বায়ুপ্রবাহ এবং বাষ্পীভবন। 

            নিম্নে এই সকল উপাদানগুলির উদ্ভিদের ওপর প্রভাব আলোচনা করা হলো।

ক) উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিকাশে সূর্যালোকের প্রভাব 

          উদ্ভিদের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপের উপর সূর্যালোক প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভূমিকা পালন করে। যেমন- 

i) ক্লোরোফিল উৎপাদন 

        কয়েক প্রকার মস ও অ্যালগি ছাড়া সব রকমের উদ্ভিদ ক্লোরোফিল উৎপাদনের জন্য সূর্যালোকের ওপর নির্ভর করে।

ii) সালোকসংশ্লেষ 

        সূর্যালোকের উপস্থিতিতে ক্লোরোফিলের সহযোগিতায় উদ্ভিদ দেহে শর্করা জাতীয় খাদ্য উৎপাদিত হয়।

iii) শ্বসন 

       উদ্ভিদের শ্বসন সূর্যালোকের ওপর নির্ভর করে। রাত্রে শ্বসনের হার বেশি হয় এবং দিনের বেলায় কম হয়।

iv) বাষ্পমোচন 

      সূর্যালোকের উপস্থিতিতে বাতাসের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। ফলে বাষ্পমোচনের হার বৃদ্ধি পায়।

v) অঙ্কুরোদগম 

       জলে ভেজা বীজ সূর্যালোকের উপস্থিতিতে অঙ্কুরিত হয়।

vi) উদ্ভিদ অঙ্গের চলন 

       উদ্ভিদ অঙ্গের চলন সূর্যালোকের উপর নির্ভর করে। উদ্ভিদের কাণ্ড আলোর দিকে এবং মূল আলোর বিপরীত দিকে চলে।

vii) উদ্ভিদের প্রকৃতি 

        নিরক্ষীয় অঞ্চলে সূর্যালোক বেশি পাওয়ায় উদ্ভিদ সুদীর্ঘ হয়। ক্রমশ মেরুর দিকে উদ্ভিদ খর্বাকার হয়।

viii) উদ্ভিদের পাতার প্রকৃতি 

          অধিক আলোক প্রাপ্ত অঞ্চলের উদ্ভিদের পাতা বড় হয় এবং মোটা হয়। কম আলোক প্রাপ্ত অঞ্চলে উদ্ভিদের পাতা ক্ষুদ্র হয় এবং পাতলা হয়।

ix) পত্ররন্ধের সঞ্চালন 

          পত্ররন্ধের খোলা এবং বন্ধ হওয়া সূর্যালোকের উপর নির্ভর করে।


উদ্ভিদের ওপর আলোর তীব্রতা, প্রকৃতি এবং স্থায়িত্বকালের প্রভাব 

i) উদ্ভিদের ওপর আলোর তীব্রতার প্রভাব 

        উদ্ভিদের ফুল, ফল ও বীজের উৎপাদনে সাহায্য করে। উন্মুক্ত স্থানে আলোর তীব্রতা বেশি হওয়ার ফলে উদ্ভিদ মোটা হয়। বনভূমির তলদেশে আলোর তীব্রতা কম হওয়ায় উদ্ভিদের কাণ্ড লম্বা হয়।

ii) উদ্ভিদের ওপর আলোর প্রকৃতির প্রভাব 

       সূর্যরশ্মির মধ্যে অবস্থিত সাতটি রং এর মধ্যে লালরশ্মি, নীলরশ্মি এবং অতিবেগুনি রশ্মি উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে প্রভাব বিস্তার করে।

     a) লাল রশ্মি→ কোষ এবং কলার বৃদ্ধি ঘটায়।

     

     b) নীল রশ্মি → কোষের বৃদ্ধি এবং প্রসারণে ব্যাঘাত ঘটায়।

     c) অতিবেগুনি রশ্মি→ শারীরবৃত্তীয় কাজের পক্ষে ক্ষতিকর।


iii) উদ্ভিদের ওপর আলোর স্থায়িত্বকালের প্রভাব

        দিনের বেলায় উদ্ভিদ কতটা সময় সূর্যালোক পায় সেই সময়কালকে আলোর স্থায়িত্বকাল বা আলোক পর্ব বলে। আলোক পর্ব অনুসারে তিন প্রকার উদ্ভিদ গোষ্ঠী দেখা যায়। যথা- 

a) ক্ষুদ্র আলোকপর্ব উদ্ভিদ (Short Day Plant)

       এইসব উদ্ভিদ 12 ঘন্টার কম দৈর্ঘ্যের আলোক পর্বে বৃদ্ধিলাভ করে। যেমন- তামাক, ডালিয়া।

b) দীর্ঘ আলোক পর্ব উদ্ভিদ (Long Day Plant) 

 

     এই সকল উদ্ভিদ 12 থেকে 14 ঘন্টার বেশি দৈর্ঘ্যের আলোকপর্বে বৃদ্ধিলাভ করে। যেমন- পাট, আলু, মূলা।

c) আলোক পর্ব নিরপেক্ষ উদ্ভিদ (Day Neutral Plant)

       এই সকল উদ্ভিদের আলোক পর্বের কোন ভূমিকা নেই। যেমন- টমেটো, তুলো।


আলোর চাহিদা অনুসারে উদ্ভিদের শ্রেণীবিভাগ

       আলোর চাহিদা অনুসারে উদ্ভিদকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যথা- 

i) আলোকপ্রেমী উদ্ভিদ (Photophilic) বা হেলিওফাইট (Heliophyte)

         এই সকল উদ্ভিদ বেশি সূর্যালোকে সবচেয়ে ভালো থাকে। যেমন- বেল, গন্ধরাজ, নয়নতারা, সূর্যমুখী, জবা।

 

      যে সকল উদ্ভিদ অধিক সূর্যের আলোতে ভালোভাবে বিকশিত হয় এবং ছায়াতেও বেঁচে থাকে তাদের ফ্যাকালটেটিভ স্কিওফাইট বলে।

ii) আলোকবিদ্বেষী উদ্ভিদ (Photophobic) বা স্কিওফাইট বা ছায়াপ্রিয় উদ্ভিদ(Sciophyte)

        এই সকল উদ্ভিদ সূর্যালোক পছন্দ করেনা। ছায়াতে জন্মাতে ভালোবাসে। যেমন- পান, গজ পিপুল, মানিপ্লান্ট, অর্কিড, ফার্ণ।

        যে সকল উদ্ভিদ কম সূর্যের আলোয় ভালোভাবে বিকশিত হলেও প্রবল সূর্যালোকে বেঁচে থাকে তাদের ফ্যাকালটেটিভ হেলিওফাইট বলে। অরণ্য অঞ্চলের ভূমিস্তরের উদ্ভিদ।


খ) উদ্ভিদের বৃদ্ধি এবং বিকাশে উষ্ণতার ভূমিকা

        যে সকল খনিজ পদার্থ গুলি উদ্ভিদ খাদ্যরূপে গ্রহণ করে তাদের মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটাতে উষ্ণতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে উষ্ণতার ভূমিকাগুলি নিম্নে আলোচিত হলো।-

i) উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিকাশ 

       বিভিন্ন অঞ্চলে উদ্ভিদের তাপমাত্রা সহ্য করার ক্ষমতা বিভিন্ন প্রকৃতির হয়। অতিরিক্ত তাপ বা শৈত্যের সম্মুখীন হলে উদ্ভিদের বিকাশ ব্যাহত হয়।

ii) দেহকোষ গঠন 

       উদ্ভিদের দেহকোষ গঠিত হয় প্রধানত প্রোটোপ্লাজম দ্বারা। যা খুব বেশি বা কম তাপমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

iii) প্রস্ফুটন কাল 

        দিন ও রাত্রির তাপমাত্রার পরিবর্তনের উপর উদ্ভিদের ফুল ফোটা এবং ফল হওয়া অনেকাংশে নির্ভর করে। উদ্ভিদের আলোকপর্ব উদ্ভিদের পুষ্পায়নে বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করে।

iv) রোগ নিয়ন্ত্রণ 

        আর্দ্র আবহাওয়ায় তাপমাত্রা বেশি কমে গেলে উদ্ভিদের দেহে বিভিন্ন রকম রোগ হয়। যেমন- পেয়াজ, পেঁপে প্রভৃতি উদ্ভিদের মূল ও কান্ড পচে যায়।

v) বিপাক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ 

        তাপমাত্রা উদ্ভিদের বিপাক ক্রিয়াকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করে। বীজের অঙ্কুরোদগম, সালোকসংশ্লেষ, শ্বসন হার প্রভৃতি শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ তাপমাত্রা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

vi) উদ্ভিদ প্রজাতির ওপর প্রভাব 

          কোন অঞ্চলে কোন ধরনের উদ্ভিদের জন্ম, বৃদ্ধি ও বিকাশ হবে তা তাপমাত্রার উপর খুব বেশি নির্ভর করে। যেমন- বেশি তাপমাত্রা যুক্ত অঞ্চলে ক্রান্তীয় চিরসবুজ এবং পাতা ঝরা উদ্ভিদ জন্মায়। খুব কম তাপমাত্রায় আল্পীয় উদ্ভিদ জন্মায়।

তাপমাত্রার তারতম্য অনুসারে উদ্ভিদের শ্রেণীবিভাগ

         উদ্ভিদের উষ্ণতার চাহিদার কাম্যস্তর অনুসারে রনকিয়ার (Raunkiaer, 1934) উদ্ভিদ মন্ডলীকে চার ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন- 

i) মেগাথার্ম (Megatherm) 

 

        যে সকল উদ্ভিদের সারা বছর অধিক উষ্ণতার প্রয়োজন তাদের মেগাথার্ম উদ্ভিদ বলে।

তাপমাত্রা: 25° থেকে 32° সেলসিয়াস।

অবস্থান: প্রধানত নিরক্ষীয় অঞ্চল। 

বৈশিষ্ট্য 

         ১. চিরসবুজ উদ্ভিদ। 

         ২. সূর্যের আলো পাওয়ার জন্য উদ্ভিদের স্তর দেখা যায়।

প্রধান উদ্ভিদ: মেহগনি, আবলুস, আয়রন উড, রোজ উড।


ii) মেসোথার্ম (Mesotherm)

         যে সকল উদ্ভিদ সারা বছর মাঝারি উষ্ণতায় জন্মায় তাদের মেসোথার্ম উদ্ভিদ বলে।

উষ্ণতা: 18° থেকে 24° সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্রয়োজন। 

অবস্থান: ক্রান্তীয় এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চল। 

বৈশিষ্ট্য: 

       ১.উদ্ভিদগুলির শুষ্ক ঋতুতে পাতা ঝরে যায়।

       ২. উচ্চতা মাঝারি হয়। 

প্রধান উদ্ভিদ: আম, জাম, কাঁঠাল, শাল, সেগুন।


iii) মাইক্রোথার্ম (Microtherm)

        যে সকল উদ্ভিদের সারা বছর অল্প উষ্ণতার প্রয়োজন হয় তাদের মাইক্রোথার্ম উদ্ভিদ বলে।

উষ্ণতা: 11° থেকে 17° সেলসিয়াস উষ্ণতা। 

অবস্থান: শীতল নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল।

বৈশিষ্ট্য: 

১. উদ্ভিদের শাখা প্রশাখা কম। 

২.দেখতে শঙ্কু আকৃতির। 

৩. কাণ্ড এবং পাতায় মোমের আবরণ থাকে।

প্রধান উদ্ভিদ: পাইন, ফার, বার্চ, সিডার, হেমলক, পপলার।


iv) হেকিস্টোথার্ম (Hekistotherm)

        যে সকল উদ্ভিদ অধিক শীতল পরিবেশে জন্মায় তাদের হেকিস্টোথার্ম বলে।

উষ্ণতা: 10° থেকে - 40° সেলসিয়াস। 

অবস্থান: মেরু অঞ্চল। 

বৈশিষ্ট্য: 

১.তৃণ ও বিরুৎ শ্রেণীর উদ্ভিদ দেখা যায়।

২.  উদ্ভিদগুলি অল্প সময় বাঁচে।

 প্রধান উদ্ভিদ: মস, লাইকেন।


গ) উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে এবং বিকাশে অধ:ক্ষেপণ এবং আর্দ্রতার প্রভাব লেখ 

উদ্ভিদের ওপর অধ:ক্ষেপণ এবং আর্দ্রতার যথেষ্ট প্রভাব আছে। যেমন- 

i) উদ্ভিদের পুষ্টি 

        মৃত্তিকার জলে যে খনিজ পদার্থ দ্রবীভূত থাকে উদ্ভিদ সেগুলি তার প্রয়োজন মত সংগ্রহ করে পুষ্টি সাধন করে।

ii) শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপ 

        উদ্ভিদের শারীরবৃত্তীয় ও অন্যান্য কাজে জল অপরিহার্য। গাছ এই জল মাটি থেকে সংগ্রহ করে।

iii) সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়া 

        উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষের জন্য জলের প্রয়োজন হয়।

iv) রস সৃষ্টি 

       উদ্ভিদের রস সৃষ্টি ও সংরক্ষণের জন্য জলের প্রয়োজন হয়।

v) প্রোটোপ্লাজম সৃষ্টি 

       প্রোটোপ্লাজম তৈরিতে জলের প্রয়োজন হয়।

vi) প্রজাতি নির্ধারণ 

        জলের যোগান অনুযায়ী উদ্ভিদ প্রজাতি নির্ধারিত হয়। 

যেমন- 

  • অধিক বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চলে চিরসবুজ উদ্ভিদ; 
  • বছরে নির্দিষ্ট সময় বৃষ্টিপাত হলে পর্ণমোচী উদ্ভিদ; 
  • বৃষ্টিপাত কম হলে তৃণভূমি ও মরু উদ্ভিদ; এবং 
  • তুষার আবৃত অঞ্চলে সরলবর্গীয় উদ্ভিদ জন্মায়।


vi) উদ্ভিদের গঠন এবং আকৃতি 

        উদ্ভিদের গঠন ও আকৃতি আর্দ্রতার ওপর নির্ভরশীল। 

        যেমন- মরু অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় উদ্ভিদের উচ্চতা বেশি হয় না এবং পাতাগুলি কাঁটায় রূপান্তরিত হয়।


ঘ) উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিকাশে বায়ুপ্রবাহের প্রভাব

         উদ্ভিদের ওপর বায়ুপ্রবাহ প্রভাব বিস্তার করে। যেমন- 

i) প্রস্বেদন ক্রিয়া

        বায়ুর তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে বাষ্পীভবনের হার বৃদ্ধি পায়। ফলে উদ্ভিদের প্রস্বেদন হার বৃদ্ধি পায়।

ii) পরাগরেনুর স্থানান্তর 

         বায়ুপ্রবাহের দ্বারা উদ্ভিদের পরাগকণা এক স্থান থেকে অন্য স্থানের স্থানান্তরিত হয়।

iii) উৎপাটন 

        প্রবল বায়ুপ্রবাহের জন্য উদ্ভিদ শিকড় সহ উৎপাটিত হয়। আবার কখনো কখনো শাখা প্রশাখা ভেঙে পড়ে।

iv) বক্রতা 

       কোন অঞ্চলে একটি নির্দিষ্ট দিক থেকে প্রতিনিয়ত বায়ু প্রবাহিত হলে উদ্ভিদের শাখা প্রশাখা বায়ুপ্রবাহের দিকে স্থায়ীভাবে বেঁকে যায়।

v) বায়ুর সঙ্গে বালিকণা, বরফকণা ইত্যাদি পরিবাহিত হলে ওগুলি উদ্ভিদের মুকুল, পাতা, ফুল ইত্যাদির ক্ষতি করে।
















একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Ads Area