চা মৃদু উত্তেজক পানীয়। সমগ্র পৃথিবীজুড়ে চা এবং কফি উত্তেজক পানীয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। শ্রীলংকার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল চা। প্রতি বছর চা রপ্তানি করে শ্রীলঙ্কা প্রচুর পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা অর্জন করে। দেশের অর্থনীতির বিকাশের ক্ষেত্রে চা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
চা উৎপাদনের অনুকূল ভৌগোলিক পরিবেশ
শ্রীলঙ্কা ক্রান্তীয় অঞ্চলে অবস্থিত একটি দেশ। এখানে বাগিচা ফসল হিসাবে চা চাষ করা হয়। চা চাষের অনুকূল ভৌগোলিক পরিবেশ নিম্নে আলোচনা করা হলো।-
ক) অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ
গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক অবস্থাগুলি হল-
(1) জলবায়ু:
(i) উষ্ণতা:
সারা বছর 18° - 30° সেলসিয়াস উষ্ণতা যুক্ত অঞ্চল চা চাষের পক্ষে আদর্শ। গ্রীষ্মকালীন উষ্ণতা 27° সেলসিয়াস হলে চা উৎপাদন ভালো হয়। শ্রীলংকার দ্বীপরাষ্ট্র এবং ক্রান্তীয় অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় সারাবছর উষ্ণতা বেশি থাকে।
(ii) বৃষ্টিপাত:
চা চাষের জন্য অধিক বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন। বার্ষিক 150 থেকে 200 সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত চা চাষের পক্ষে আদর্শ। 100 সেন্টিমিটারের কম বৃষ্টিপাত চা চাষের পক্ষে ক্ষতিকর। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু এবং প্রত্যাবর্তনকারী মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে শ্রীলঙ্কায় সারাবছর প্রায় বৃষ্টিপাত হয়।
(iii) তুহিন মুক্ত দিবস:
তুষারপাত চা গাছের ক্ষতি করে এ কারণে তুষার মুক্ত পরিবেশ চা চাষের পক্ষে আদর্শ। শ্রীলঙ্কা ক্রান্তীয় অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় তুষারপাত হয় না।
(2) মৃত্তিকা:
লোহা ও ম্যাঙ্গানিজ যুক্ত অম্লধর্মী উর্বর মাটি চা চাষের পক্ষে আদর্শ। পটাশ এবং ফসফরাস যুক্ত মাটিতে চা চাষ করা হয়।
(3) ভূমি:
চা গাছের গোড়ায় জল দাঁড়ালে চা গাছের ক্ষতি করে। এই কারণে ঢালু পার্বত্য ভূমি তে চা চাষ করা হয়। যেখান থেকে বৃষ্টির জল দ্রুতগতিতে নিচের দিকে নেমে যায়। শ্রীলঙ্কার মধ্যভাগে উচু পার্বত্য অঞ্চল থাকায় পাহাড়ের ঢালে জল জমতে পারে না, ফলে চা চাষের উপযোগী পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।
(4) ছায়া প্রদানকারী উদ্ভিদ:
সরাসরি সূর্যের আলো চা গাছের ক্ষতি করে। এই কারণে চা বাগিচার মাঝে ছায়া প্রদানকারী উদ্ভিদ রোপন করতে হয়।
খ) অনুকূল অর্থনৈতিক পরিবেশ
(1) শ্রমিক:
চা বাগানগুলিতে প্রচুর সুলভ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। চা পাতা তোলা, পাতাগুলিকে কারখানায় স্থানান্তরিত করা, এই সকল কাজে প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। ভারতের তামিলরা চা বাগিচাগুলিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে।
(2) মূলধন:
চা বাগিচা নির্মাণ করার জন্য প্রথমে প্রচুর পরিমাণে মূলধনের প্রয়োজন হয়। বাগান পরিচর্যা, শ্রমিকের মজুরি, সার প্রয়োগ প্রভৃতি কাজে প্রচুর মূলধনের প্রয়োজন।
(3) পরিবহন:
চায়ের পাতা বাগান থেকে তোলার পর দ্রুত কারখানায় পাঠানো প্রয়োজন, না হলে পাতা শুকিয়ে গিয়ে চায়ের গুণমান নষ্ট হয়। বাগিচা থেকে চা কারখানা গুলির মধ্যে উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
(4) চা বাগিচার পরিচর্যা:
চা গাছের পুষ্টি সাধনের জন্য নিয়মিত সার প্রয়োগ করতে হয়।
শ্রীলঙ্কার চা উৎপাদক অঞ্চলের বিবরণ দাও
শ্রীলঙ্কা চা উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ স্থান(চীন, ভারত ও কেনিয়ার পরে) অধিকার করে। FAO এর তথ্য অনুসারে 2017-18 সালে শ্রীলংকা 3.50 লক্ষ টন চা উৎপাদন করেছিল। চা রপ্তানিতে শ্রীলঙ্কা পৃথিবীতে প্রথম স্থান অধিকার করে। শ্রীলঙ্কায় 6 টি প্রধান চা উৎপাদক অঞ্চল আছে। এগুলি হল-
1) ক্যান্ডি (Kandy):
ক্যান্ডিতে সর্বপ্রথম চায়ের চা শুরু হয়। এই অঞ্চলের দক্ষিণ-মধ্যভাগের পার্বত্য অঞ্চলের ঢালে 600 থেকে 1200 মিটার উচ্চতায় অপেক্ষাকৃত শীতল আর্দ্র জলবায়ুতে অধিকাংশ চা উৎপাদিত হয়। তবে হেক্টর প্রতি উৎপাদনের পরিমাণ এখানে অনেক কম।
2) উভা:
শ্রীলঙ্কার মধ্যভাগের পার্বত্য অঞ্চলের পূর্বঢালে উভা অঞ্চলের 1000 থেকে 1700 মিটার উচ্চতায় উন্নতমানের চা চাষ হয়। এই অঞ্চলের ওলেমাডো, ডেমোডারা, পোনাগালা প্রভৃতি স্থানে চা উৎপাদন হয়।
শ্রীলঙ্কার চা উৎপাদক অঞ্চল |
3) নুয়ারা এলিয়া (Nuwara Eliya)
শ্রীলঙ্কার মধ্যভাগে নুয়ারা এলিয়া অঞ্চলে উন্নতমানের চা উৎপাদন হয়। এই অঞ্চলের 2000 মিটার উচ্চতা পর্যন্ত চা চাষ হয়। এই দেশের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট চা এখানে উৎপাদিত হয়।
4) উভা পুসেলায়া অঞ্চল:
নুয়ারা এলিয়া অঞ্চল ও উভা অঞ্চলের মধ্যবর্তী স্থানে উভা পুসেলায়া অঞ্চল অবস্থিত। উত্তর-পূর্ব মৌসুমী বায়ু সক্রিয় থাকায় এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এবং চা চাষের উপযোগী পরিবেশের সৃষ্টি করে। মাটুরাটা, রাগালা এখানকার প্রধান চা উৎপাদন কেন্দ্র।
5) ডিমবুলা:
1870 সালে এখানে প্রথম চায়ের চাষ শুরু হয়। এখানকার উচ্চভূমির পশ্চিম ঢালে 1100 থেকে 1700 মিটার উচ্চতায় উন্নতমানের চা চাষ করা হয়।
6) রুহুনা অঞ্চল:
শ্রীলঙ্কার দক্ষিণ ভাগে রুহুনা অঞ্চলে কম উচ্চতায় ( 600 মিটার) উন্নতমানের কালো চা উৎপাদন করা হয়।
শ্রীলঙ্কার চা চাষের সমস্যা
1) ভূমিক্ষয়:
শ্রীলঙ্কার মধ্যভাগ উঁচু হওয়ায় প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণে ভূমিক্ষয় হয়। ফলে মাটির উপরিভাগের উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়। যা চা গাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে না।
2)কম উৎপাদন:
শ্রীলঙ্কায় হেক্টর প্রতি চায়ের উৎপাদন কম। প্রতি হেক্টরে প্রায় 1540 কেজি, যেখানে কেনিয়ার উৎপাদন প্রতি হেক্টরে 2318 কেজি।
3)শ্রমিক সমস্যা:
শ্রীলঙ্কার সরকার দ্বারা তামিল জনগণের প্রতি বিরূপ মনোভাব এবং অত্যাচারের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিক চা বাগিচাগুলিতে পাওয়া যায় না।
4) বিকল্প পানীয়:
চায়ের বিকল্প পানীয় হিসেবে বর্তমানে কফির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় চায়ের চাহিদা কমেছে।
5) পুরাতন চা বাগিচা শ্রীলঙ্কার অধিকাংশ চা বাগিচাগুলি ঊনবিংশ শতাব্দীতে স্থাপন করা হয়েছে। পরবর্তীতে নতুন করে বাগিচা তেমন গড়ে তোলা হয়নি।
শ্রীলঙ্কায় চায়ের গুরুত্ব
1) চা শ্রীলঙ্কার একটি গুরুত্বপূর্ন বাণিজ্যিক ফসল।
2) শ্রীলঙ্কার প্রায় 16 লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে চা চাষ এবং চাষ শিল্পের সঙ্গে জড়িত।
3) জাতীয় আয়ের 5 শতাংশ আসে চা থেকে।
4) শ্রীলঙ্কার প্রধান রপ্তানি দ্রব্য হলো চা এবং প্রতি বছর চা রপ্তানি করে 1 বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক অর্থ উপার্জন করে।
5) আন্তর্জাতিক বাজারে স্বাদ এবং সুগন্ধের জন্য শ্রীলঙ্কার চায়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
পৃথিবী ব্যাপী চা উৎপাদন (লক্ষ টন) 2017-18
দেশ | চা উৎপাদন(লক্ষ টন) |
---|---|
১. চিন | 24.73 |
২. ভারত | 13.25 |
৩. কেনিয়া | 4.39 |
৪.শ্রীলংকা | 3.50 |
শ্রীলঙ্কার চায়ের প্রকারভেদ
চায়ের ধরন | গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য |
---|---|
কালো চা (Black Tea) | পৃথকভাবে বা মিশ্রিত অবস্থায় ব্যবহার করা হয়। |
সবুজ চা (Green Tea) | তীব্র গন্ধ বিশিষ্ট চা। |
সাদা চা (White Tea) | সিলভার টিপ নামে বিখ্যাত |
শ্রীলঙ্কার চায়ের বাণিজ্য
শ্রীলঙ্কা চা রপ্তানিকারক দেশ। বর্তমানে (2017-2018) শ্রীলঙ্কা চা রপ্তানিতে প্রথম স্থান অধিকার করে। এই দেশ সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, রাশিয়া, তুরস্ক, সৌদি আরব, জাপান প্রভৃতি দেশে চা রপ্তানি করে।
শ্রীলংকার চা গবেষণা কেন্দ্র কোথায় অবস্থিত?
উ: রত্নপুরা।