অর্থনৈতিক কার্যাবলী কাকে বলে?
জীবনধারণের জন্য বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত থেকে মানুষ সম্পদের উৎপাদন, বন্টন, বিনিময়, ভোগ এবং পরিষেবা প্রদানের মাধ্যমে পৃথিবীব্যাপী মানুষের যে নানাধরনের ক্রিয়াকলাপ লক্ষ্য করা যায় তাকে অর্থনৈতিক কার্যাবলী বলে। যেমন- কৃষিকাজ, পশুপালন, মৎস্যচাষ, খনিজ সম্পদ আহরণ, নির্মাণকাজ, শিল্পকর্ম প্রভৃতি।
কোন কাজগুলি অর্থনৈতিক কাজ নয়?
চুরি, ডাকাতি, লুট, ভিক্ষা, খুন, অগ্নিসংযোগ, দাঙ্গা, যুদ্ধ, প্রতারণা প্রভৃতি কাজ মানুষ ও প্রকৃতির ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় না। এই কারণে এই কাজগুলিকে অর্থনৈতিক কাজ বলা হয় না।
অর্থনৈতিক কার্যাবলীর শ্রেণীবিভাগ (Classification of Economic Activities)
সমস্ত ধরনের অর্থনৈতিক কাজকে পাঁচটি স্তরে ভাগ করা যায়। যথা-
ক) প্রাথমিক বা প্রথম স্তরের অর্থনৈতিক কাজ ( Primary Economic Activities)
প্রথম শ্রেণীর অর্থনৈতিক ক্রিয়া-কলাপ |
প্রধানত নিজের প্রয়োজনে প্রকৃতি থেকে সরাসরি সম্পদ সংগ্রহ করাকে প্রাথমিক বা প্রথম স্তরের অর্থনৈতিক কাজ বলে। মানুষ নিজের এবং সমাজের প্রাথমিক চাহিদা, যেমন- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে এই ধরনের অর্থনৈতিক কার্যাবলীর সঙ্গে যুক্ত হয়।
সমগ্র পৃথিবীর 49% মানুষ এবং ভারতের মোট জনসংখ্যার 60% মানুষ প্রথম শ্রেণীর অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যুক্ত। ভারতের জাতীয় আয়ের 18% এই ক্ষেত্র থেকে আসে।
প্রাথমিক বা প্রথম স্তরের অর্থনৈতিক কার্যাবলীর উদাহরণ:
বনজ সম্পদ সংগ্রহ, বন্যপ্রাণী শি, খনিজ সম্পদ আহরণ, পাথরকাটা, মৎস্য শিকার, অ্যাকুয়াকালচার, পশুপালন, পশম সংগ্রহ, পোল্ট্রি ফার্মিং, জীবিকা সত্ত্বাভিত্তিক কৃষি, দুধ নিষ্কাশন প্রভৃতি।
বৈশিষ্ট্য
- এই ধরনের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ প্রাকৃতিক পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
- নিজের প্রয়োজন মেটানোর জন্য এই ধরনের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ সম্পাদিত হয়।
- এই ধরনের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের জন্য প্রচলিত পদ্ধতি এবং জৈবশক্তির ব্যবহার করা হয়।
- এই অর্থনৈতিক কার্যাবলীতে উৎপাদিত দ্রব্য শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
- জমিনির্ভর এই ধরনের অর্থনৈতিক কার্যাবলী প্রধানত গ্রামকেন্দ্রিক।
- দৈহিক শ্রম এবং পশুশক্তি অধিক ব্যবহার করা হয়।
- পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ এই ধরনের অর্থনৈতিক কার্যাবলীর সঙ্গে যুক্ত।
- বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এই ক্ষেত্রে নিযুক্ত কর্মীর সংখ্যা কমছে।
- অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে এই ক্ষেত্রে নিযুক্ত কর্মীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
- কাজের প্রকৃতি এবং ধরন একই রকম হওয়ার জন্য এই এস্তরে নিযুক্ত কর্মীদের লাল পোশাকের শ্রমিক বা Red-collar Workers বলে।
খ) মাধ্যমিক বা দ্বিতীয় স্তরের অর্থনৈতিক ক্রিয়া-কলাপ (Secondary Economic Activities)
দ্বিতীয় শ্রেণীর অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ |
যে কাজের দ্বারা প্রাথমিক ক্ষেত্র বা প্রথম স্তর থেকে পাওয়া দ্রব্যের আকৃতিগত রূপান্তর ঘটিয়ে তাকে আরো বেশি কার্যকরী, ব্যবহারযোগ্য এবং অধিক মূল্যবান দ্রব্যে পরিণত করা হয়, তাকে মাধ্যমিক বা দ্বিতীয় স্তরের অর্থনৈতিক কার্যাবলী বলে।
ভারতের প্রায় 12 শতাংশ শ্রমজীবী মানুষ দ্বিতীয় স্তরের সঙ্গে যুক্ত।
উদাহরণ:
ছোট বড় শ্রমশিল্প; বাণিজ্যিক কৃষিকাজ; বাণিজ্যিক হারে মৎস্য শিকার; ইট, কাঠ, পাথরের সাহায্যে গৃহনির্মাণ; যন্ত্রপাতি ও যানবাহন নির্মাণ; কয়লার সাহায্যে তাপবিদ্যুৎ; খরস্রোতা নদীর সাহায্যে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রভৃতি।
বৈশিষ্ট্য
- এই প্রকার অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপে প্রথম ক্ষেত্র থেকে পাওয়া দ্রব্যের আকারের এবং গুণগত পরিবর্তন ঘটানো হয়।
- অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ প্রযুক্তি নির্ভর।
- জড়শক্তি বিশেষ করে কয়লা, পেট্রোলিয়াম প্রভৃতি জ্বালানির ব্যবহার করতে হয়।
- প্রচুর পরিমাণে মূলধন বিনিয়োগ করা প্রয়োজন হয়।
- প্রাকৃতিক পরিবেশের ভূমিকা এই ক্ষেত্রে সীমিত। এটি অপেক্ষাকৃত লাভজনক অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ।
- এই ধরনের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ নগর বা শহরকেন্দ্রিক।
- দ্রব্যের গুণমান এবং ব্যবহারযোগ্যতা অনেক গুণ বেড়ে যায়।
- সম্পদের কার্যকারিতা এবং উপযোগিতা বাড়ে।
- দেশের দ্রুত অগ্রগতিতে সহায়তা করে।
- এই ধরনের অর্থনৈতিক কার্যাবলী পরিবেশ দূষণ ঘটায়।
- উন্নত দেশে সবচেয়ে বেশি কর্মী এই ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত।
- দ্বিতীয় স্তরের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের নীল পোশাকের শ্রমিক বা Blue-collar Workers বলে।
গ) প্রগৌণ বা তৃতীয় স্তরের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ (Tertiary Economic Activity or Service Sector)
তৃতীয় শ্রেণীর অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ |
প্রথম এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে উৎপন্ন পণ্যসামগ্রী বিক্রয়কেন্দ্রে পাঠানো, বিক্রয় প্রভৃতি কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিযুক্ত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে তৃতীয় স্তরের অর্থনৈতিক ক্রিয়া-কলাপ বলে।
যেহেতু এইসব কাজের মাধ্যমে মানুষ সমাজকে অনেক পরিষেবা দেয়, তাই এই ক্ষেত্রকে পরিষেবামূলক অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপও বলে।
ভারতের মোট 23 শতাংশ শ্রমজীবী মানুষ এই ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত।
আরো পড়ুন
শিপিং লাইন ও শিপিং লেন কি?
রেলপথের সুবিধা এবং অসুবিধা লেখো।
উদাহরণ
ব্যবসাবাণিজ্য, পরিবহন, শিক্ষকের শিক্ষাদান, আইনজীবীর আইনি পরামর্শ, পুলিশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, ব্যাংক, বীমা ও অন্যান্য আর্থিক সংস্থা, পণ্যমজুত, হিমঘর, দর্জি, মুচি, বিউটিশিয়ান, দোকানদার, বাসচালক, ডাক্তার, নার্স, আমলা, অভিনেতা, শিল্পী, অফিসার প্রভৃতি।
বৈশিষ্ট্য
- উৎপাদক এবং ভোগকারির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ তৈরি করে।
- এই কাজ মূলত বাজার নির্ভর। বাজারের চাহিদা সম্পর্কে উৎপাদনকারীকে খবর দেয় এবং উৎপাদনকারী দ্রব্য উৎপাদন করে।
- প্রথম এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রের উন্নতি অনেক বেশি পরিমাণে পরিষেবামূলক কার্যাবলীর ওপর নির্ভরশীল।
- বিভিন্ন প্রকার অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের মধ্যে তৃতীয় স্তর বা পরিষেবা ক্ষেত্রের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি।
- সংগঠিত অপেক্ষা অসংগঠিত ভাবে এই স্তরে কাজের নিযুক্ত লোকের সংখ্যা বেশি।
- দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই স্তরের কার্যাবলী গুরুত্বপূর্ণ।
- এই স্তরের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের গোলাপী পোশাকের শ্রমিক বা Pink Collar Workers বলে।
আরো পড়ুন
সড়ক পথের সুবিধা এবং অসুবিধা লেখো।
বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বা SEZ কি?
ঘ) চতুর্থ স্তর বা নব্য অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ (Quaternary Services)
চতুর্থ শ্রেণীর অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ |
অতি উন্নত মেধা ও দক্ষতার সাহায্যে যেসব আধুনিক অর্থনৈতিক উদ্যোগ গড়ে তোলা হয় তাকে চতুর্থ স্তরের বা নব্য অর্থনৈতিক কার্যাবলী বলে।
উদাহরণ
তথ্য ও প্রযুক্তি; কম্পিউটার ও টেলিযোগাযোগ; জমি ও বাড়ির কারবার বা রিয়েল এস্টেট; তথ্য ও সংবাদ সংগ্রহ; পরিবেশন প্রভৃতি।
বৈশিষ্ট্য
- মূলত উন্নত দেশগুলিতে এই ক্ষেত্রের সর্বাধিক বিকাশ ঘটে।
- উচ্চপ্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল।
- এই ক্ষেত্রের মাধ্যমে উন্নত যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়।
- এই স্তরে কাজগুলি বড় শহর ও বাণিজ্য কেন্দ্র অর্থাৎ বাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে।
- নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করতে এই স্তরের কার্যাবলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- মননশীল কাজের প্রাধান্য এই স্তরে বেশি।
- প্রায় সমস্ত কাজ ঘরোয়া পরিবেশে করা হয়।
- এই স্তরের সঙ্গে যুক্ত কর্মীর সংখ্যা প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের তুলনায় কম।
- গবেষণালব্ধ ফল দিয়ে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের কাজের উন্নতি ঘটানো সম্ভব হয়।
- এই স্তরের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের সাদা পোশাকের শ্রমিক বা White Collar Workers বলে।
ঙ) অতি নব্য স্তর বা পঞ্চম স্তরের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ (Quinary Economic Activities)
বিশেষ মানসিক দক্ষতা ও উৎপাদন ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাযুক্ত কিছু কাজকর্মকে পঞ্চম স্তরের বা সর্বোচ্চ স্তরের কার্যাবলী বা অতি নব্য স্তরের কার্যাবলী বলে।
উদাহরণ
গবেষক; বিজ্ঞানী; বিশেষজ্ঞ ডাক্তার; ইঞ্জিনিয়ার; উকিল; ব্যারিস্টার; আর্থিক উপদেষ্টা; বিভিন্ন পদাধিকারী; প্রশাসনিক কর্মকর্তা; পরিকল্পনা রচনা; উপগ্রহ পরিষেবা; রিমোট সেন্সিং ও জিআইএস প্রভৃতি।
বৈশিষ্ট্য
- এই ক্ষেত্রটি অর্থনৈতিক কার্যাবলীর সর্বোচ্চ এবং সর্বশেষ স্তর।
- এই স্তরের কাজে বেশি জ্ঞান বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা প্রয়োজন হয়।
- অত্যন্ত প্রখর বুদ্ধিমান, জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি এইসব অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এদের বুদ্ধির ভান্ডার বা Think Tank বলে।
- কেবলমাত্র বরিষ্ঠ পেশাদারী বুদ্ধিজীবীরা এই ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করে।
- অন্যান্য অর্থনৈতিক কাজে যুক্ত মানুষের থেকে এই শ্রেণীর কাজে যুক্ত মানুষের সংখ্যা সীমিত।
- সরকারি বা বেসরকারি স্তরে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গবেষণা, তথ্যপ্রযুক্তি, প্রভৃতি কাজে নীতি প্রণয়ন, পরিকল্পনা তৈরি ও রুপায়ন ইত্যাদি কাজে সঙ্গে এই স্তরের কর্মীরা যুক্ত থাকে।
- এই স্তরের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের সোনালী পোশাকের শ্রমিক বা Gold Collar Workers বলে।
আরো পড়ুন
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা WTO কি?
ওপেক (OPEC) কি?
জলপথের সুবিধা এবং অসুবিধা লেখো।
ইন্টারনেটের গুরুত্ব লেখো।