ক) চ্যুতির সংজ্ঞা
চ্যুতি হল শিলা দেহের ফাটল। এই ফাটল বরাবর শিলাখণ্ড গুলি স্থানান্তরিত হয়। ভূবিজ্ঞানী বিলিংস (Billings) এর মতে- " চ্যুতি বলতে শিলা দেহের সেই ফাটলকে বোঝায় যার দুপাশে অবস্থিত শিলাস্তূপ গুলি একে অপরের থেকে দূরে সরে যায়।" চ্যুতিকে স্রংস বলে।চুতি বরাবর শিলাস্তূপ কয়েক সেন্টিমিটার থেকে কয়েক হাজার মিটার সরে যেতে পারে।
খ) চ্যুতি গঠনের প্রক্রিয়া
ভঙ্গুর পদার্থে পীড়নের মান একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলে পদার্থটিতে ফাটলের সৃষ্টি হয়। ফাটল আবার পীড়ন অক্ষের সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট কোন উৎপন্ন করে। পীড়ন অক্ষ মূলত তিন প্রকার।
যদি প্রধান পীড়ন অক্ষকে s1 মধ্যবর্তী পীড়ন অক্ষকে s2 এবং ক্ষুদ্রতম প্রধান পীড়ন অক্ষকে s3 ধরা হয়, তবে পীড়নের ফলে দুটি ফাটলের সৃষ্টি হয়। ফাটল দুটি পরস্পর s2 পীড়ন অক্ষকে ছেদ করে এবং s1 পীড়ন অক্ষের সঙ্গে 30° কোণ উৎপন্ন করে।
s1অক্ষ বরাবর পীড়ন বেশি হওয়ায় এখানে ভূপৃষ্ঠের সংকোচন হয় এবং s3 অক্ষ বরাবর পীড়ন সবচেয়ে কম হওয়ায় এখানে ভূপৃষ্ঠের প্রসারণ হয়।
E.M. Anderson (1951) এর মত
আন্ডারসনের মতে ধরে নেওয়া হয়েছে যে, ভূ-ত্বকের পীড়নের প্রধান তিনটি অক্ষের মধ্যে একটি উলম্ব থাকে এবং অন্য দুটি অনুভূমিক থাকে। পীড়ন অক্ষের অবস্থান অনুসারে বিভিন্ন প্রকার চ্যুতির সৃষ্টি হয়।
১. স্বাভাবিক চ্যুতি বা অভিকর্ষ চ্যুতি
যদি s2 এবং s3 পীড়ন অক্ষ অনুভূমিকভাবে অবস্থান করে এবং s1 পীড়ন অক্ষ উলম্ব হয়। তখন উলম্ব দিকে বেশি পীড়ন ক্রিয়া করার ফলে s3 দিকে (অনুভূমির দিকে) ভূমির প্রসারণ হয়।এর ফলে ঝুলন্ত প্রাচীর বা ঊর্ধ্বস্তূপ নিচের দিকে নেমে গিয়ে স্বাভাবিক চ্যুতি বা অভিকর্ষ চ্যুতি সৃষ্টি করে।
২. বিপরীত চ্যুতি বা থ্রাস্ট চ্যুতি
যদি s1 এবং s2 পীড়ন অক্ষ অনুভূমিক ভাবে অবস্থান করে এবং s3 উলম্ব থাকে, তাহলে s3 (উলম্ব) র দিকে কম বল প্রযুক্ত হয়। কিন্তু অনুভূমিক দিকে বেশি বল প্রযুক্ত হওয়ার ফলে ভূমির সংকোচন হয়। ফলে উলম্ব দিকে ভূমির আয়তনের প্রসারণ ঘটে। ফলস্বরূপ ঝুলন্ত প্রাচীরটি উপরের দিকে উঠে যায় এবং বিপরীত চ্যুতি বা থ্রাস্ট চ্যুতি গঠন করে।
৩. আয়াম স্খলন চ্যুতি
যদি s1 ও s3 অনুভূমিক থাকে এবং s2 উলম্ব হয় তাহলে অনুভূমির দিকের চেয়ে উলম্ব দিকে অপেক্ষাকৃত কম পীড়ন হওয়ায় s3 দিকে শিলাখণ্ডের সরণ ঘটে। একে আয়াম স্খলন চ্যুতি বলে।
গ) চ্যুতি গাঠনিক উপাদান
১. চ্যুতি (Fault) কি?
সংনমন বা পীড়ন এবং টান বা প্রসারণ জনিত বলের প্রভাবে শিলাস্তরে ফাটলের সৃষ্টি হয়। ফাটলের দুপাশের শিলাখণ্ড গুলি পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে একে অন্যের থেকে দূরে সরে গেলে তাকে চ্যুতি বা Fault বলে।
২. চ্যুতি তল (Fault Plane)
যে তল বরাবর চ্যুতির দুপাশের শিলাখণ্ড গুলি স্থানান্তরিত হয় অথবা একে অপরের থেকে দূরে সরে যায়, তাকে চ্যুতিতল বলে। চ্যুতিতলের প্রকৃতি অনুসারে কয়েক প্রকার চ্যুতিতল দেখা যায়। যথা-
i) স্লিকেনসাইড (Slickenside)
আঁচড়কাটা দাগযুক্ত চ্যুতিতলকে স্লিকেনসাইড বলে। শিলাস্তূপের প্রবল ঘর্ষণের জন্য এইরকম সৃষ্টি হয়।
ii) চ্যুতি ব্রেকসিয়া (Fault Breccia)
কোনযুক্ত শিলাচূর্ণ যুক্ত চ্যুতিতলকে চ্যুতি ব্রেকসিয়া বলে।
iii) ফ্লুকন (Flucon)
অগভীর মাটির স্তর দ্বারা ঢাকা চ্যুতিতলকে ফ্লুকন বলে।
iv) গুজ (Gusse)
পাউডারের মতো শিলাকণা পূর্ণ চ্যুতিতলকে গুজ বলে।
৩. চ্যুতিরেখা (Fault Line)
চ্যুতিতল ভূ-পৃষ্ঠকে যে রেখা বরাবর ছেদ করে তাকে চ্যুতিরেখা বলে।
৪. চ্যুতিতলের নতি (Fault Dip)
চ্যুতিতল অনুভূমিক তলের সঙ্গে যে কোন উৎপন্ন করে তাকে চ্যুতিতলের নতি বলে।
৫. চ্যুতিতলের আয়াম (Fault Strike)
অনুভূমির তল এবং চ্যুতিতল যে কাল্পনিক রেখা বরাবর পরস্পরকে ছেদ করে তাকে চ্যুতিতলের আয়াম বলে।
৬. চ্যুতিকোণ বা হেড (Hade)
চ্যুতিতল উলম্ব তলের সঙ্গে যে কোনে অবস্থান করে তাকে চ্যুতিকোণ বা হেড বলে। চ্যুতিতলের নতি এবং চ্যুতি কোণের যোগফল 90° হয়।
৭. ক্ষেপ (Throw)
চ্যুতির ফলে সৃষ্ট ঝুলন্ত প্রাচীর এবং পাদমূল প্রাচীরের মধ্যে উলম্ব ব্যবধানকে ক্ষেপ বলে।
৮. ব্যবধি (Heave)
চ্যুতির ফলে সৃষ্ট ঝুলন্ত প্রাচীর এবং পাদমূল প্রাচীরের মধ্যে অনুভূমিক ব্যবধানকে ব্যবধি বলে।
৯. ঝুলন্ত প্রাচীর বা ঊর্ধ্বস্তূপ (Hanging Wall)
চ্যুতিতলের ওপরে অবস্থিত ভূখণ্ডটিকে ঝুলন্ত প্রাচীর বা ঊর্ধ্বস্তূপ বলে। চ্যুতিতলের ওপরে ভূ-খণ্ডটি ঝুলে আছে বলে মনে হয়।
১০. পাদমূল প্রাচীর বা অধোস্তূপ (Foot Wall)
চ্যুতি তলের নিচে অবস্থিত ভূ-খণ্ডটিকে পাদমূল প্রাচীর বা অধোস্তূপ বলে।
চ্যুতিতল উলম্ব হলে ঝুলন্ত প্রাচীর বা পাদমূল প্রাচীর সৃষ্টি হয় না।
১১. ঊর্ধ্বক্ষেপ এবং অধ:ক্ষেপ (Upthrow side and Downthrow side)
চ্যুতিতল বরাবর যে ভূখণ্ডটি উপরে অবস্থান করে তাকে ঊর্ধ্বক্ষেপ এবং যে ভূখণ্ডটির নিচে অবস্থান করে তাকে অধঃক্ষেপ বলে।
আরও পড়ুন
- চ্যুতির ফলে গঠিত ভূমিরূপ
- স্বাভাবিক চ্যুতি, বিপরীত চ্যুতি বা বিলোম চ্যুতি, সোপান চ্যুতি এবং পরিখা চ্যুতি, সংঘট্ট চ্যুতি বা থ্রাস্ট চ্যুতি বা থ্রাস্ট