Type Here to Get Search Results !

ভূমিকম্প ( Earthquake)

 ভূমিকম্প কাকে বলে? 

           বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানুষের কার্যাবলীর প্রভাবে ভূপৃষ্ঠ অল্প সময়ের জন্য হঠাৎ কেঁপে ওঠে। এইরকম আকস্মিক এবং ক্ষণস্থায়ী কম্পনকে বলা হয় ভূমিকম্প বা ভূকম্প। 

    ভূমিকম্পের স্থায়িত্বকাল

           ভূমিকম্প কয়েক সেকেন্ড থেকে 1-2 মিনিট স্থায়ী হয়। কখনো কখনো কম্পন এতই মৃদু হয় যে আমরা অনুভব করতে পারি না। অল্প সময়ের ভূমিকম্পেও প্রচুর সম্পত্তি এবং জীবনের হানি করে। 

    ভূমিকম্পের বৈশিষ্ট্য 

  1. ভূমিকম্প ভূ- অভ্যন্তরে সৃষ্টি হয়। 
  2. এটি ক্ষণস্থায়ী হয়। 
  3. ভূমিকম্প সৃষ্টির নির্দিষ্ট সময় নেই। 
  4. ক্ষণস্থায়ী ভূমিকম্পে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়।

ভূমিকম্পের কেন্দ্র ( Focus) 

          ভূ-অভ্যন্তরে যেখানে ভূমিকম্প তরঙ্গের উৎপত্তি হয় তাকে ভূমিকম্পের কেন্দ্র বলে। এই কেন্দ্র থেকে ভূমিকম্প তরঙ্গের উৎপত্তি হয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে।

    ভূমিকম্প কেন্দ্রের গভীরতা 

         ভূপৃষ্ঠ থেকে 16 কিলোমিটারের মধ্যে অধিকাংশ ভূমিকম্প কেন্দ্র অবস্থান করে। 

    ভূমিকম্প কেন্দ্রের প্রকার

        বেণো গুটেনবার্গের মত অনুযায়ী অবস্থান অনুসারে ভূমিকম্প কেন্দ্র তিন প্রকার। যথা- 

               i) অগভীর কেন্দ্র----------- ভূপৃষ্ঠ থেকে 70 কিলোমিটার। 

              ii) মাঝারি গভীর কেন্দ্র---- 70 থেকে 300 কিলোমিটার গভীর। 

             iii) গভীর কেন্দ্র ------------300 থেকে 700 কিলোমিটার গভীর।

ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র (Epicentre)

          ভূমিকম্প কেন্দ্রের ঠিক সোজাসুজি ভূপৃষ্ঠে অবস্থিত যে স্থানে ভূমিকম্পের তরঙ্গ প্রথম পৌঁছায় সে স্থান বা বিন্দুকে ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র বলে।

    বৈশিষ্ট্য

  1. উপকেন্দ্রে প্রথম কম্পন অনুভব করা যায়। 
  2. উপকেন্দ্র থেকে ভূমিকম্পের মাত্রা চারিদিকে কমতে থাকে। 
  3. উপকেন্দ্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়। 
  4. এটি ভূমিকম্প কেন্দ্রের নিকটবর্তী স্থান। 
  5. উপকেন্দ্র সংলগ্ন অঞ্চলে ক্ষয়ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হয় বলে একে প্লাইস্টোসিসমিক অঞ্চল বলে।

ভূমিকম্প তরঙ্গ 

        ভূকম্পবিদ জন মিশেল 1755 খ্রিস্টাব্দে ভূমিকম্প তরঙ্গ আবিষ্কার করেন। 

        ভূমিকম্পের প্রভাবে যে শক্তির সৃষ্টি হয় ভূমিকম্প কেন্দ্র থেকে তা তরঙ্গের আকারে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তরঙ্গ প্রথমে উপকেন্দ্রে আঘাত করে। উপকেন্দ্র থেকে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। উপকেন্দ্র থেকে যতই দূরে যাওয়া যায় তরঙ্গ ততই শক্তি হারিয়ে ফেলে।

ভূমিকম্প তরঙ্গের শ্রেণীবিভাগ 

          ভূমিকম্প তরঙ্গ প্রধানত দুই প্রকার। যথা- A) দেহ তরঙ্গ এবং B) পৃষ্ঠতরঙ্গ।

A) দেহ তরঙ্গ 

         ভূমিকম্প কেন্দ্র থেকে উৎপত্তি হয়ে যে তরঙ্গ পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগে প্রবেশ করতে পারে তাকে দেহ তরঙ্গ বলে। দেহ তরঙ্গের সাহায্যে পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগের গঠন, স্তরবিন্যাস, উপাদান প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে জানা যায়। দেহ তরঙ্গ দুই প্রকার। যথা- P তরঙ্গ এবং S তরঙ্গ। 

   ক) P তরঙ্গ বা প্রাথমিক তরঙ্গ ( Primary wave)

                 ভূমিকম্প কেন্দ্র থেকে যে তরঙ্গ সর্বপ্রথম উপকেন্দ্রে আসে তাকে প্রাথমিক তরঙ্গ বা P তরঙ্গ বলে।

   P তরঙ্গের বৈশিষ্ট্য

  1. এই তরঙ্গের গতিবেগ সবচেয়ে বেশি প্রতি সেকেন্ডে 6 থেকে 8 কিলোমিটার। 
  2. তরঙ্গ যেদিকে অগ্রসর হয় তার সমান্তরালে মাধ্যমের কণা কাঁপতে থাকে বলে একে অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ বলে। 
  3. শব্দ তরঙ্গের মতো সংকোচন প্রসারণের দ্বারা অগ্রসর হওয়ায় একে সংনমন তরঙ্গ (Compressional wave) বলে। 
  4. এই তরঙ্গ কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় পদার্থের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে পারে। 
  5. এই তরঙ্গ প্রবাহিত হওয়ার সময় জোরে ধাক্কা দেয় বলে একে ধাক্কা তরঙ্গ বা ঠেলা তরঙ্গ (Push wave) বলে। 
  6. এই তরঙ্গ সবচেয়ে শক্তিশালী তরঙ্গ। 
  7. এই তরঙ্গের দৈর্ঘ্য ছোট হয় এবং তরঙ্গ সংখ্যা অনেক বেশি হয়। 
  8. ভূককম্পলিক যন্ত্রে প্রথম ধরা পড়ে বলে একে প্রাথমিক তরঙ্গ বলে। 


খ) গৌণ বা মাধ্যমিক তরঙ্গ বা S তরঙ্গ (Secondary wave)

               ভূমিকম্প কেন্দ্র থেকে উপকেন্দ্রে P তরঙ্গের পরে এসে পৌঁছায় বলে একে গৌণ বা মাধ্যমিক তরঙ্গ বা S তরঙ্গ বলে।

   S তরঙ্গের বৈশিষ্ট্য 

  1. P তরঙ্গের থেকে কম গতিবেগ সম্পন্ন। প্রতি সেকেন্ডে 3 থেকে 5 কিলোমিটার। 
  2. এই তরঙ্গ অগ্রসর হওয়ার সময় মাধ্যমের কণাগুলি উলম্বভাবে বা সমকোণে উঠানামা করে বলে একে অনুপ্রস্থ তরঙ্গ বলে। 
  3. এই তরঙ্গ আলোক তরঙ্গের অনুরূপ। 
  4. কেবলমাত্র কঠিন পদার্থের মধ্য দিয়ে যেতে পারে।  
  5. এই তরঙ্গ কঠিন পদার্থে পীড়ন সৃষ্টি করে বলে একে পীড়ন তরঙ্গ বলে। 
  6. এই তরঙ্গ পদার্থের আকৃতির পরিবর্তন ঘটালেও আয়তনের পরিবর্তন ঘটায় না। 
  7. গ্রাহক যন্ত্রে P তরঙ্গের পরে ধরা পড়ে বলে একে দ্বিতীয় প্রাথমিক তরঙ্গ (Second primary tremor) বলে। 
  8. তরঙ্গ দৈর্ঘ্য P তরঙ্গের থেকে বড় কিন্তু S তরঙ্গের থেকে ছোট হয়।


B) পৃষ্ঠ তরঙ্গ বা পার্শ্ব তরঙ্গ বা L তরঙ্গ (Surface or Lateral wave)

        ভূমিকম্পের কেন্দ্র থেকে ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে যে তরঙ্গ অগ্রসর হয় তাকে পৃষ্ঠ তরঙ্গ বা L তরঙ্গ বলে।

  L তরঙ্গের বৈশিষ্ট্য 

  1. এই তরঙ্গের গতিবেগ সবচেয়ে কম। 2 থেকে 4 কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ডে। 
  2. তরঙ্গ যেদিকে অগ্রসর হয় তার সাপেক্ষে মাধ্যমের কণাগুলি তীর্যকভাবে উঠানামা করে বলে এটি তির্যক তরঙ্গ। 
  3. কঠিন পদার্থের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে হারিয়ে যায়। 
  4. শিলার আকৃতি এবং আয়তনের পরিবর্তন ঘটায়। 
  5. তরঙ্গ দৈর্ঘ্য অনেক বেশি হওয়ায় একে L তরঙ্গ বলে। 
  6. P এবং S তরঙ্গের থেকে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বলে গ্রাহক যন্ত্রে সবার শেষে পৌঁছায়। 
  7. P এবং S তরঙ্গের পরে এই তরঙ্গ মূল ঝাকুনি (Main Shock) দেয় বলে এর ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। 
  8. P এবং S তরঙ্গের বৈশিষ্ট্য বহন করে। L তরঙ্গ P তরঙ্গের বৈশিষ্ট্যযুক্ত হলে তাকে র‍্যালে তরঙ্গ  এবং S তরঙ্গের বৈশিষ্ট্যযুক্ত হলে তাকে লাভ তরঙ্গ (Love wave) বলে। 


সমকম্পনকাল রেখা ( Homoseismals)

            কোনো স্থানে ভূমিকম্প হলে পৃথিবীর যেসব জায়গায় একই সময়ে ভূমিকম্পের কম্পন জানা যায় বা নথিভুক্ত করা হয়, সেই সকল স্থানকে যোগ করে যে কাল্পনিক রেখা পাওয়া যায় তাকে সমকম্পন কাল রেখা বলে। 


সমতীব্রতা রেখা ( Isoseismal line)

           ভূমিকম্পের সমান তীব্রতাযুক্ত স্থানগুলোকে যে কাল্পনিক রেখার সাহায্যে যুক্ত করা হয় তাকে সমতীব্রতা রেখা বলে।


ভূকম্পলিখ যন্ত্র বা সিসমোগ্রাফ (Seismograph)

            যে যন্ত্রের সাহায্যে ভূমিকম্প তরঙ্গের গতিবিধির রেখাচিত্র পাওয়া যায়, তাকে ভূকম্পলিখ যন্ত্র বা সিসমোগ্রাফ বলে। 

          জন মিলনে সিসমোগ্রাফ যন্ত্রের আবিষ্কারক।


ভূমিকম্প পরিলেখ বা সিসমোগ্রাম ( Seismogram)

          সিসমোগ্রাফ যন্ত্রে যে পরিলেখ বা গ্রাফে ভূমিকম্প তরঙ্গগুলি আঁকা হয় তাকে ভূমিকম্প পরিলেখ বা সিসমোগ্রাম বলে।।



ভূমিকম্পের তীব্রতা পরিমাপ করা হয় কিসের সাহায্যে?

         রিখটার স্কেল ও মার্কালি বা মার্সেলি স্কেলের সাহায্যে ভূমিকম্পের তীব্রতা মাপা হয়।

i) রিখটার স্কেল (Richter scale)

   রিখটার স্কেলের সংজ্ঞা

            ভূমিকম্পের শক্তির মাত্রা বা তীব্রতা যে স্কেলের সাহায্যে পরিমাপ করা হয় তাকে রিখটার স্কেল বলে।

   আবিষ্কারক 

           ১৯৩৫ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ভূকম্পবিদ চার্লস  রিখটার এই স্কেলের উদ্ভাবন করেন।

    স্কেলের মাত্রা 

          তিনি রিখটার স্কেলের মাত্রা 0 থেকে 10 পর্যন্ত সংখ্যায় চিহ্নিত করেন। মাত্রাগুলি লগারিদমীয় হওয়ায় স্কেলের 1 একক মাত্রা বৃদ্ধি পেলে ভূমিকম্পের শক্তির পরিমাণ পূর্ববর্তী মাত্রা বা আগের মাত্রা থেকে 10 গুণ বেশি হয়।

         যেমন-- 6 মাত্রা 5 মাত্রার থেকে 10 গুণ বেশি শক্তিশালী। 7 মাত্রা 5 মাত্রার থেকে 100 গুণ বেশি শক্তিশালী।

     উদাহরণ 

          2004 সালে 26 শে ডিসেম্বর উত্তর-পূর্ব ভারত মহাসাগরে যে ভূমিকম্প হয়েছিল তার মাত্রা ছিল 8.9 ।

ii) মার্কালি বা মার্সেলি স্কেল (Mercalli scale)

         জুসেপ্পি মার্কালি এই স্কেলের উদ্ভাবক। এই স্কেলে 1 থেকে 12 পর্যন্ত ভাগ (I -XII) আছে। মানুষের অভিজ্ঞতা এবং জনবসতির ক্ষয়ক্ষতির ভিত্তিতে এই স্কেলের মান নির্ধারণ করা হয়।


ভূকম্পছায়া অঞ্চল বা ভূকম্পছায়া বলয় (Seismic shadow zone)

         ভূমিকম্পের কেন্দ্র থেকে উপকেন্দ্রের মধ্যে সংযোগকারী সরলরেখার সাপেক্ষে ভূমিকম্পের কেন্দ্রে উৎপন্ন 103° থেকে 143°এর মধ্যে অবস্থিত অঞ্চলে কোনরকম ভূমিকম্প তরঙ্গ সিসমোগ্রাফে ধরা পড়ে না। একে ভূমিকম্পের ছায়া বলয় বলে।

   ভূকম্প ছায়াবলয় সৃষ্টির কারণ

            S তরঙ্গ তরল পদার্থের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করতে পারে না বা তরল পদার্থে শোষিত হয়। পৃথিবীর কেন্দ্রমন্ডলের বাইরের অংশ তরল পদার্থ গঠিত হওয়ায় S তরঙ্গ প্রবেশ করতে পারেনা। ফলে 103° এর পরবর্তী অংশে ভূমিকম্প কেন্দ্রের বিপরীতে সিসমোগ্রাফ যন্ত্রে S তরঙ্গ ধরা পড়ে না। 103° পরবর্তী অংশকে S তরঙ্গের ছায়া অঞ্চল বলে।

           P তরঙ্গ কেন্দ্রমণ্ডলে প্রবেশ করার পর তার গতির দিক পরিবর্তন হয়। ফলে 103° থেকে 143° অঞ্চল পর্যন্ত P তরঙ্গ সিসমোগ্রাফ যন্ত্রের ধরা পড়ে না। কোনরূপ ভূমিকম্প তরঙ্গ 103° থেকে 143° অঞ্চলে পৌঁছাতে পারেনা বলে এই অঞ্চল বা বলয়কে ভূকম্পছায়া বলয় বলে।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Ads Area