ভূমিকম্পের কারণ ( Causes of Earthquake)
ভূমিকম্পের কারণগুলিকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- 1) প্রাকৃতিক কারণ এবং 2) কৃত্রিম কারণ।
1) প্রাকৃতিক কারণ ( Physical Causes)
প্রাকৃতিক কারণ কে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
যথা- ক) ভু-গাঠনিক কারণ খ) অ-ভূগাঠনিক কারণ।
ক) ভু-গাঠনিক কারণ (Tectonic Causes)
i) পাতের চলন
ভূত্বক কয়েকটি পাতে বিভক্ত। পাতগুলি পরস্পরের কাছে চলে আসায় অথবা দূরে সরে যাওয়ার ফলে ভূমিকম্প হয়। তিন প্রকার পাত সীমানায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প হয়।
a) প্রতিসারী পাতসীমানা
একটি পাত অপর পাত থেকে দূরে সরে গেলে ভূ- অভ্যন্তর থেকে ম্যাগমা উঠে আসে। ফলে ভূমিকম্প হয়। আটলান্টিক মহাসাগরের সামুদ্রিক শৈলশিরা বরাবর এই কারণে ভূমিকম্প হয়।
b) অভিসারী পাতসীমানা
দুটি পাতের মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে অপেক্ষাকৃত ভারী পাতটি হালকা পাতের নিচে প্রবেশ করে। প্রবেশ করা পাতটির ঢালু পাতসীমানা বরাবর ভূমিকম্প কেন্দ্রের সৃষ্টি হয়। এই পাতসীমানা বরাবর পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প হয়। যেমন- জাপানের ভূমিকম্প অভিসারী পাতসীমানা বরাবর সৃষ্টি হয়।
c) নিরপেক্ষ পাতসীমানা
দুটি পাত পরস্পরকে পাশ কাটিয়ে চলে যাবার সময় মৃদু ভূমিকম্প হয়। যেমন- যুক্তরাষ্ট্রের সান আন্দ্রিজ চ্যুতি, নিউজিল্যান্ডের আল্পীয় চ্যুতি অঞ্চল।
ii) নবীন ভঙ্গিল পর্বতের উত্থান
গিরিজনি আলোড়নের প্রভাবে প্রবল পার্শ্বচাপে পলিস্তর ভাঁজপ্রাপ্ত হয়ে উপরে উঠে ভঙ্গিল পর্বত সৃষ্টি করে। এর ফলে শিলাস্তরের স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হয়ে ভূমিকম্প হয়। উদাহরণ- হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের ভূমিকম্প।
iii) চ্যুতির সৃষ্টি
শিলাস্তরে প্রচন্ড সংকোচন ও প্রসারণজনিত বলের প্রভাবে চ্যুতির সৃষ্টি হলে ভূমিকম্প হয়। যেমন- গুজরাটের ভুজ(2001), বিহারের ভূমিকম্প(1934)।
iv) অগ্ন্যুদপাত
আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ এবং ছিদ্রপথ দিয়ে ভূ- অভ্যন্তরের ম্যাগমা বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য ভূত্বকে প্রচণ্ড চাপের সৃষ্টি হয়। এর ফলে ভূমিকম্প হয়। যেমন- প্রশান্ত মহাসাগরীয় আগ্নেয় মেখলা অঞ্চলে এই কারণে ভূমিকম্প হয়।
v) পৃথিবীর তাপ বিকিরণ
পৃথিবীর সৃষ্টির সময় জ্বলন্ত গ্যাসীয়পিণ্ড ছিল। তারপর থেকে পৃথিবী এখনো পর্যন্ত তাপ বিকিরণ করে ক্রমশ শীতল এবং সংকুচিত হচ্ছে। এর ফলে ভূত্বকের স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হয়ে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
vi) সমস্থিতিক ভারসাম্য নষ্ট
ভূত্বকের পর্বত, মালভূমি, সমভূমি ভূ-অভ্যন্তরের গলিত স্তরের উপর ভেসে রয়েছে। এরা পরস্পর ভারসাম্য রক্ষা করে অবস্থান করে। এই অংশগুলির বিভিন্ন স্থানে ক্ষয় এবং ক্ষয়িত পদার্থের সঞ্চয়ের ফলে ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়। ফলে ভূমিকম্প হয়। যেমন- 1949 সালের লাহোরের ভূমিকম্প।
vii) ভু-অভ্যন্তরের বাষ্প চাপ
ভূ-অভ্যন্তরে অত্যধিক তাপের ফলে জল ও অন্যান্য পদার্থ বাষ্পে পরিণত হয়। এই বাষ্প বেরিয়ে আসার জন্য ভূত্বকে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করে। ফলে ভূমিকম্প হয়।
viii) ভূ-আলোড়ন
মহিভাবক এবং গিরিজনি আলোড়নের প্রভাবে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
খ) অ-ভূগাঠনিক কারণ ( Non - Tectonic Causes)
i) ধস
কাস্ট অঞ্চলে ভৌমজলের ক্ষয়কার্যের ফলে ভূ-অভ্যন্তরে গহবর সৃষ্টি হয়। এই গহবরের ছাদ ধসে পড়ে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
ii) হিমানী সম্প্রপাত
পার্বত্য অঞ্চলে বিশাল বরফের খন্ড পর্বতের ঢাল বরাবর নিচে নামে এবং ভূমিকম্প সৃষ্টি করে। যেমন- পেরুর ভূমিকম্প (1970)।
iii) সমুদ্র তরঙ্গের আঘাত
সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে সমুদ্র তরঙ্গের প্রবল আঘাতে ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়।
iv) উল্কাপাত
বড় মাপের উল্কা ভূপৃষ্ঠে পড়লে ভূমিকম্প হয়।
v) জলপ্রপাত
বড় মাপের জলপ্রপাত থেকে বিপুল পরিমাণ জল ওপর থেকে নিচে পড়লে ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়।
2) কৃত্রিম কারণ (Artificial Causes)
i) বাঁধ বা জলধার নির্মাণ
নদীতে বাঁধ দিয়ে জলধার নির্মাণ করা হয়। জলাধারে বিপুল পরিমাণ জলসঞ্চিত হলে জলের প্রচন্ড চাপে শিলার স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হয়, ফলের ভূমিকম্প হয়। যেমন- 1967 সালে মহারাষ্ট্রের কয়না জলাধরের জলের চাপে ভূমিকম্প হয়েছিল।
ii) পারমাণবিক বিস্ফোরণ
পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ভূগর্ভে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ করলে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ভূমিকম্প হয়। যেমন- 1974 এবং 1999 সালে রাজস্থানের পোখরানে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ফলে ভূমিকম্প হয়েছিল।
iii) খনিজ পদার্থ উত্তোলন
ভু-অভ্যন্তর থেকে খনিজ পদার্থ উত্তোলন করলে বড় বড় গহবর সৃষ্টি হয়। এই গহবরের ধ্বস নামলে ভূমিকম্প হয়।
iv) ডিনামাইট বিস্ফোরণ
পার্বত্য অঞ্চলের রেলপথ, সড়কপথ, সুরঙ্গ নির্মাণের জন্য ডিনামাইট বিস্ফোরণ করা হয়। এর ফলে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
ভূমিকম্পের ফলাফল (Effects of Earthquake)
ভূমিকম্পের প্রভাব ভূমিরূপ এবং মানবজাতির ওপর দেখা যায়। যেমন-
ক) ভূ-তাত্ত্বিক ফলাফল বা ভূমিরূপের ওপর প্রভাব
i) ফাটল, চ্যুতি, স্তূপ পর্বত এবং গ্রস্ত উপত্যকার সৃষ্টি
ভূমিকম্পের ফলে ভূত্বকে ফাটলের সৃষ্টি হয়। এই ফাটলের মধ্যবর্তী ভূ-ভাগ উপরে উঠে স্তূপ পর্বত এবং নিচের দিকে বসে গিয়ে গ্রস্ত উপত্যকার সৃষ্টি করে। যেমন- নর্মদা, তাপ্তি গ্রস্ত উপত্যকা; বিন্ধ্য ও সাতপুরা স্তূপ পর্বত এইভাবে সৃষ্টি হয়েছে।
ii) ভঙ্গিল পর্বত গঠন
ভঙ্গিল পর্বত গঠনের সময় পলিস্তরে চাপ পড়ায় ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়। পলিস্তর ভাঁজ প্রাপ্ত হয়ে উপরে উঠে ভঙ্গিল পর্বত সৃষ্টি করে।
iii) ভূমির উত্থান এবং অবনমন
ভূমিকম্পের ফলে উপকূলভাগ উপরে উঠে যেতে পারে অথবা নিচে বসে যেতে পারে। যেমন- 1819 সালে কচ্ছের রান অঞ্চল নিচে বসে গিয়েছিল।
iv) কাদা গ্যাস ও বাষ্প নির্গমন
ভূমিকম্পের ফলে ফাটল বা ছিদ্রপথ দিয়ে কাদামাটি, গ্যাস ও বাষ্প নির্গত হয়।
v) নদীর গতিপথ পরিবর্তন
ভূমিকম্পের ফলে ভূমির ঢালের পরিবর্তন হয় অথবা নদীপথ রুদ্ধ হয়ে নদীর গতিপথের পরিবর্তন হয়। যেমন- 1950 সালে আসামের ভূমিকম্পের ফলে দিবং নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছিল।
vi) অগ্ন্যুদগম
ভূমিকম্পের প্রভাবে ফাটল বা ছিদ্রপথ দিয়ে ম্যাগমা বেরিয়ে আসে।
v) হ্রদ সৃষ্টি
ভূমিকম্পের ফলে নদীর গতিপথের রুদ্ধ হয়ে হ্রদ সৃষ্টি হয়। যেমন- 1950 সালে আসামের ভূমিকম্পের ফলে নদীর গতিপথ রুদ্ধ হয়ে মাধুরী হ্রদ সৃষ্টি হয়েছে।
vi) প্রস্রবণ
ভূমিকম্পের ফলে ভূ-অভ্যন্তরের জল বেরিয়ে এসে প্রস্রবনের সৃষ্টি করে।
vii) সুনামি সৃষ্টি
ভূমিকম্পের ফলে উপকূল অঞ্চলে প্রবল সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়, যা সুনামি নামে পরিচিত। যেমন- 2004 সালে ভারত মহাসাগরের সুনামি।
খ) মানবজীবনে প্রভাব
i) কৃষি কাজে ক্ষতি
ভূমিকম্পের ফলে চাষের জমি এবং কৃষিজ ফসলের ক্ষতি হয়। প্রচুর গবাদি পশু মারা যায়।
ii) পরিকাঠামো ধ্বংস
সড়কপথ, রেলপথ, সেতু, বাড়িঘর প্রভৃতির বিপুল ক্ষতি হয়।
iii) জীবনহানি
অল্প সময়ের জন্য হলেও ভূমিকম্পের ফলে প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়।
iv) অগ্নিকাণ্ড
বড় বড় বিল্ডিং এ অগ্নিকাণ্ড ঘটে।
v) বিদ্যুৎ ব্যবস্থার বিপর্যয়
বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হয়।
ভূমিকম্পের সুফল বা গঠনমূলক প্রভাব
i) ভূমিকম্প তরঙ্গগুলির গতিবিধি পর্যালোচনা করে ভূ-অভ্যন্তরের গঠন, তাপ, চাপ, উপাদান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
ii)ভূমিকম্পের মাধ্যমে ভঙ্গিল পর্বত, আগ্নেয় পর্বত বা স্তূপ পর্বতের সৃষ্টি হয়।
iii) ভূ-অভ্যন্তর থেকে কাদা ও বালির সঙ্গে বিভিন্ন খনিজ পদার্থ বাইরে বেরিয়ে আসে।
iv) ভূমিকম্পের ফলে অনেক সময় ভূ-অভ্যন্তরের জল তলের উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। ফলে প্রস্রবনের সৃষ্টি হয়।
v) সমুদ্রতলদেশ উপরে উঠে স্থলভাগের সৃষ্টি হয়।
vi) উপকূল ভাগ নিমজ্জিত হয়ে উপসাগর সৃষ্টি হতে পারে। যা বন্দর নির্মাণের উপযোগী হয়।
ভূমিকম্পের পূর্বাভাস
- গ্যাল ভানো মিটার যন্ত্রের সাহায্যে শিলার তরিৎপ্রবাহ ও প্রতিরোধ ক্ষমতা র তারতম্য পর্যবেক্ষণ করে।
- ভূ-অভ্যন্তরে শিলাস্তরে চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তণ বিশ্লেষণ করে।
- শিলার স্থিতিস্থাপকতা ধর্মের পরিবর্তনে ভূমিকম্প তরঙ্গ বিস্তারের গতিবেগের বৈষম্য পরিমাপ করে।
- কূপের জলের র্যাডনের পরিমাণ এবং এর তাপমাত্রা তারতম্য, জলপৃষ্ঠের পরিবর্তন লক্ষ্য করে।
- উপকূলের সমুদ্রের জলের হঠাৎ পেছনদিকে সরে যাওয়া লক্ষ্য করে।
- গরু-হনুমানের কান খাড়া হওয়া, ক্যাটফিশের চঞ্চলতা বৃদ্ধি ইত্যাদি জীবজন্তুর আচরণের পরিবর্তন লক্ষ্য করে।
- ভূমিকম্প ঘটার পূর্বে উপকেন্দ্র অঞ্চলের ভূপৃষ্ঠ হেলে যাওয়ার প্রতি লক্ষ্য রেখে।