মৃত্তিকা পরিলেখ কাকে বলে?
উপযুক্ত পরিবেশে যে পরিণত মৃত্তিকার সৃষ্টি হয় সেই মৃত্তিকার প্রস্তচ্ছেদ করলে ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে কয়েকটি স্তর বা হরাইজন দেখা যায়, মৃত্তিকার এই প্রস্তচ্ছেদকে মৃত্তিকা পরিলেখ (Soil Profile) বলে।
স্তরগুলি পাললিক শিলাস্তরের মতো নয়। রেগোলিথের উপরিস্তর থেকে সহজ দ্রবণীয় পদার্থ ধৌত প্রক্রিয়ায় বা দ্রবীভূত প্রক্রিয়ায় নিচের দিকে নেমে যায় এবং সঞ্চিত হয়। ফলে বিভিন্ন গভীরতায় মৃত্তিকার ভৌত, রাসায়নিক এবং জৈব বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য দেখা যায়। যেগুলি মৃত্তিকা স্তর বা হরাইজন নামে পরিচিত। মৃত্তিকা বিজ্ঞানীগণ মৃত্তিকার পাঁচটি প্রধান স্তর চিহ্নিত করেছেন যেমন- O, A, B, C, D । নিম্নে এগুলি আলোচিত হলো।
ক) জৈব হরাইজন বা O হরাইজন
ভূপৃষ্ঠের ঠিক উপরে জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ স্তরটিকে জৈব স্তর বা O হরাইজন বলে।
বৈশিষ্ট্য
i) এই স্তরের গভীরতা কম।
ii) জৈব পদার্থ আংশিক ও সম্পূর্ণ বিয়োজিত থাকে।
iii) এই স্তরের রং গাঢ় কালো।
iv) তৃণভূমি এবং অরণ্যে এই স্তর স্পষ্টভাবে দেখা যায়।
উপস্তর
জৈব স্তরের প্রকৃতিগত পার্থক্যের ভিত্তিতে এই স্তরকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
১. Oi স্তর
জৈব স্তরের একেবারে উপরিভাগে উদ্ভিদ থেকে সদ্য পতিত পাতা, ফুল, ফল ইত্যাদি সঞ্চিত হয়ে গঠিত হয়। এই স্তরের অপর নাম Ao স্তর।
২. Oe স্তর
Oi উপস্তরের ঠিক নিচে অবস্থিত। এই স্তরটিতে জৈব পদার্থের আংশিক বিকৃতি হয়। পাতা, ফুল, ফল ইত্যাদির গঠন চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। এই উপস্তরটিকে Aoo উপস্তর বলা হয়।
৩. Oa স্তর
Oe স্তরের ঠিক নিচে অবস্থিত। এই স্তর জৈব পদার্থ সম্পূর্ণ জারিত অবস্থায় থাকে। ফলে পাতা, ফুল, ফল ইত্যাদি সনাক্তকরণ সম্ভব নয়। এই স্তরকে Aooo উপস্তর বলা হয়।
খ) A হরাইজন
O হরাইজনের ঠিক নিচে A হরাইজন অবস্থিত। এই স্তর থেকে মূল মৃত্তিকা শুরু হয়।
বৈশিষ্ট্য
i) এই স্তরটি খনিজ পদার্থ দ্বারা গঠিত।
ii) স্তরের উপরিভাগে জৈব স্তর অবস্থিত হওয়ায় স্তরটি জৈব পদার্থ যুক্ত হয়ে পড়ে।
iii) এই স্তরের উপরের অংশের মৃত্তিকার রং কালো হয়।
iv) এই স্তর থেকে বিভিন্ন খনিজ পদার্থ নিচের দিকে স্থানান্তরিত হওয়ায় একে এলুভিয়াল স্তর বলে।
v) বিভিন্ন জলবায় যুক্ত অঞ্চলে এই স্তরের গভীরতা ভিন্ন হয়।
উপস্তর
এই স্তরটি তিনটি উপস্তরে বিভক্ত। যথা-
১. A1 উপস্তর
A হরাইজনের উপরিস্তর। জৈব পদার্থ মিশ্রিত থাকায় এর রং কালো হয়। পডসল মৃত্তিকায় উপস্তরটির গভীরতা কম এবং চার্নোজেম মৃত্তিকায় এই উপস্তরটির গভীরতা বেশি হয়।
২. A2 উপস্তর
A1 উপস্তরের নিচে অবস্থিত। এই উপস্তরটি খনিজ পদার্থ দ্বারা গঠিত। এলুভিয়েশন প্রক্রিয়া এই উপস্তরে সবচেয়ে বেশি কার্যকর হয়। ফলে রং হালকা বা ধূসর হয়।
৩. A3 উপস্তর
A এবং B স্তরের মধ্যবর্তী উপস্তর। উভয় স্তরের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা গেলেও A স্তরের বৈশিষ্ট্য বেশি থাকে।
গ) B হরাইজন
A স্তরের নিচে অবস্থিত। A স্তর থেকে ধৌত প্রক্রিয়ায় আগত পদার্থসমূহ এই স্তরে সঞ্চিত হয় অর্থাৎ ইলুভিয়েশন প্রক্রিয়া এই স্তরে কার্যকরী হয়।
বৈশিষ্ট্য
i) স্তরটি মূলত খনিজ পদার্থ সমৃদ্ধ।
ii) খনিজ ও জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ হয় স্তরটির রং গাঢ় হয়।
iii) উদ্ভিদের প্রচুর খাদ্য মৌল এই স্তরে সঞ্চিত থাকে।
iv) A স্তর থেকে আসা পদার্থ এখানে সঞ্চিত হওয়ায় এই স্তরকে ইলুভিয়াল স্তর বলে।
উপস্তর
এই স্তরটির তিনটি উপস্তর রয়েছে। যথা-
১. B1 উপস্তর
B স্তরের উপরে অবস্থান করে। A স্তর সংলগ্ন থাকায় উভয় স্তরের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। কিন্তু B স্তরের বৈশিষ্ট্য বেশি থাকে।
২. B2 উপস্তর
B1 উপস্তরের নিচে অবস্থিত। A স্তর থেকে আগত খনিজ পদার্থ যেমন- খনিজ লবণ, ক্যালসিয়াম কার্বনেট, ক্যালসিয়াম সালফেট এই স্তরে সঞ্চিত হয়। তাই একে ইলুভিয়েটেড স্তর বলে।
৩. B3 উপস্তর
B2 উপস্তরের নিচে অবস্থিত B এবং C উভয় স্তরের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। কিন্তু B স্তরের বৈশিষ্ট্য বেশি থাকে।
ঘ) C হরাইজন
B স্তরের নিচে অবস্থিত। এটি আবহবিকার গ্রস্ত পদার্থ দ্বারা গঠিত। মূল শিলা বা আদিশিলা আবহবিকার প্রাপ্ত হয়ে এই স্তরটি গঠিত হয়। আবহবিকার ক্রমাগত চলতে থাকলে এই স্তরটি B স্তরে পরিণত হয়।
উপস্তর
স্তরটির দুটি উপস্তর রয়েছে-
১. C1 উপস্তর
C স্তরের উপরে অবস্থিত।সূক্ষ্ম শিলাচূর্ণ দ্বারা এই উপস্তরটি গঠিত হয়।
২. C2 উপস্তর
C1 উপস্তরের নিচে অবস্থিত। এখানকার শিলাচূর্ণ গুলি অপেক্ষাকৃত বড় হয়। এগুলি সামান্য পরিবর্তিত অবস্থায় থাকে।
ঙ) D বা R হরাইজন
এই স্তরটি মূল শিলাস্তর বা জনক শিলাস্তর দ্বারা গঠিত। এই শিলাস্তর আবহবিকার প্রাপ্ত হয়ে পরবর্তীতে মাটির সৃষ্টি করে।
কর্তৃক পরিলেখ কি?
ভূ আলোড়নের ফলে কোন স্থান উলম্বভাবে উপরে উঠে গেলে ভূমির ঢাল বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী কালে ক্ষয় কার্যের মাধ্যমে এই ভূমির উপরিভাগের স্তর ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। ফলে মৃত্তিকার সবকটি স্তর লক্ষ্য করা যায় না। এই ধরনের মৃত্তিকা পরিলেখকে কর্তৃক বলে।
যদি মৃত্তিকার উপরের A স্তর সম্পূর্ণভাবে অপসারিত হয় তবে B স্তর মৃত্তিকার উপরে অবস্থান করে।
ডাফ (Duff) কি?
সরলবর্গীয় অরণ্য অঞ্চলে মৃত্তিকার উপরের জৈব স্তরটিকে ডাফ বলে।
মাল (Mull) কি?
পর্ণমোচী অরণ্য অঞ্চলে মৃত্তিকার উপরিভাগের জৈব পদার্থ গঠিত স্তরকে মাল বলে।
মাল (Mull) কি?
মৃত্তিকা পরিলেখের A এবং B এস স্তর হলো প্রকৃত মৃত্তিকা A এবং B স্তরকে একত্রে সোলাম বলে।