জেট বায়ু প্রবাহ কি ? বা জেট বায়ু কাকে বলে?
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে 10-12 কিমি উচ্চতায় অর্থাৎ ট্রপোস্ফিয়ারের ঊর্ধ্বসীমায় প্রবাহিত প্রবল গতি সম্পন্ন বাতাসকে জেট বায়ু বলে। এই বাতাস আঁকাবাঁকা পথে প্রবাহিত এক প্রকার জিওস্ট্রপিক বায়ু।
জেট বায়ুর উৎপত্তি
জেট বায়ু |
ঊর্ধ্ব বাতাসে ঘর্ষণজনিত বাধা থাকে না। এই অংশে উচ্চচাপ এবং নিম্নচাপের অবস্থানের জন্য (অর্থাৎ দুটি বিপরীত ধর্মী বায়ু পরস্পর মিলিত হলে) উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে নিম্নচাপের দিকে বাতাস প্রবাহিত হয়। বায়ু প্রবাহিত হওয়ার সময় বায়ুর চাপের ঢাল এবং কোরিওলিস বল পরস্পর বিপরীতমুখী হওয়ায় বায়ু সমচাপ রেখার সমান্তরালে পশ্চিম থেকে পূর্বে প্রবাহিত হয়। একে জিওস্ট্রপিক বাতাস বলে। এই বাতাস জেট বায়ু নামে পরিচিত।
উষ্ণ ক্রান্তীয় বায়ু এবং শীতল মেরু বায়ু পরস্পর যেখানে মিলিত হয় সেই পরিবর্তনশীল অঞ্চলের জেট বায়ু প্রবাহিত হয়।
উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ ও নিরক্ষীয় নিম্নচাপের মাঝে পূর্ব থেকে পশ্চিমে একটি জেট বায়ু প্রবাহিত হয়।
জেট বায়ুর বৈশিষ্ট্য
- এই বায়ু 7 থেকে 12 কিলোমিটার উচ্চতায় প্রবাহিত হয়।
- এই বায়ু সংকীর্ণ অংশের মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা বা সর্পিল পথে প্রবাহিত হয়।
- পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। শুধুমাত্র ক্রান্তীয় জেট বায়ু পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হয়।
- জেট বায়ুর গতিবেগ বেশি হয়। প্রায় 100 থেকে 500 কিলোমিটার/ প্রতি ঘন্টা।
- জেট বায়ুর দৈর্ঘ্য কয়েক হাজার কিলোমিটার হয় এবং প্রস্থ কয়েক শত কিলোমিটার হয়। এইবায়ু 1 থেকে 2 কিলোমিটার পুরু হয়।
- শীতকালে এই বাতাসের বেগ ক্রমশ বৃদ্ধি পায় এবং এই সময় জেট বায়ুগুলি নিরক্ষরেখার দিকে কিছুটা সরে যায়।
- জেট বায়ু উভয় গোলার্ধে 30° থেকে 60° অক্ষরেখার মধ্যে অর্থাৎ মধ্য অক্ষাংশে অবস্থান করে।
- জেট বায়ু তিন ভাগে বিভক্ত যথা- মেরু জেট বায়ু, উপক্রান্তীয় জেট বায়ু এবং ক্রান্তীয় জেট বায়ু। মেরু জেট বায়ু অনেক বেশি শক্তিশালী হয়।
- জেট বায়ুর একটা নির্দিষ্ট জীবনচক্র আছে। এটি 4 টি পর্যায় সম্পন্ন হয়।
- পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ঝড়ঝঞ্ঝা, বৃষ্টিপাতের প্রকৃতি এবং পরিমাণ জেট বায়ুর উপর নির্ভর করে।
জেট বায়ুর প্রকারভেদ
১. মেরুদেশীয় জেট বায়ু
উভয় গোলার্ধে 30° থেকে 60° অক্ষাংশের মধ্যে এই বায়ু দেখা যায়। উষ্ণ উপক্রান্তীয় বায়ু এবং শীতল মেরু বায়ু যেখানে মিলিত হয় সেখানে সীমান্ত বরাবর এই জেট বায়ুর উৎপত্তি হয়। এটি পশ্চিম থেকে পূর্বে প্রবাহিত হয়। সব ধরনের জেট বায়ুর মধ্যে মেরুদেশীয় জেট বায়ু সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়।
২. উপক্রান্তীয় জেট স্ট্রিম
উপক্রান্তীয় অঞ্চলে 25° থেকে 30° অক্ষরেখা বরাবর ঊর্ধ্ব ট্রপোস্ফিয়ারে ( মূলত 10 থেকে 16 কিলোমিটার উচ্চতায়) উপক্রান্তীয় জেট স্ট্রিম প্রবাহিত হয়। মেরুদেশীয় জেট স্ট্রিমের তুলনায় উপক্রান্তীয় জেট স্ট্রিমের উচ্চতা অনেক বেশি। এই বায়ু বেশ দুর্বল হয়। এই বায়ু হ্যাডলি কোষ এবং ফেরেল কোষকে পৃথক করে।
৩. ক্রান্তীয় জেট স্ট্রিম
উত্তর গোলার্ধে গ্রীষ্মকালে আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঊর্ধ্ব বায়ুমণ্ডলে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে পূর্বালি জেট স্ট্রিম বা ক্রান্তীয় জেট স্ট্রিম প্রবাহিত হয়। এটি যথেষ্ট দুর্বল বায়ুস্রোত। প্রধানত গ্রীষ্মকালে পরিলক্ষিত হয়।
রসবি তরঙ্গ (Rossby waves)
উত্তর গোলার্ধে জলভাগের তুলনায় স্থলভাগের পরিমাণ বেশি। ফলে মধ্য অক্ষাংশীয় অঞ্চলে জেট বায়ু তরঙ্গের আকৃতিতে প্রবাহিত হয়। একে রসবি তরঙ্গ বলে। আবহ বিজ্ঞানী সি. জি. রসবি (C.G. Rossby) গাণিতিক পদ্ধতিতে এই তরঙ্গায়িত বায়ুপ্রবাহের অস্তিত্বের প্রমাণ করেছিলেন বলে এইরকম নামকরণ হয়েছে।
রসবি তরঙ্গের বৈশিষ্ট্য
- ট্রপোস্ফিয়ারের উপরের অংশে দেখা যায়।
- প্রবল গতিবেগ সম্পন্ন বায়ুপ্রবাহ।
- তরঙ্গ দৈর্ঘ্য 5 - 6 হাজার কিলোমিটার।
আবহাওয়া এবং জলবায়ুর উপর জেট বায়ুর প্রভাব অথবা জেট বায়ুর গুরুত্ব লেখ।
জেট বায়ু ঊর্ধ্ব বায়ুমণ্ডলের একটি বায়ুপ্রবাহ। পৃথিবী ব্যাপী আবহাওয়া এবং জলবায়ুকে জেট বায়ু প্রবাহ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। নিচে জেট বায়ুর প্রভাবগুলি আলোচনা করা হলো,-
১. মধ্য অক্ষাংশীয় ঘূর্ণবাত
নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে দুটি বিপরীত ধর্মী বায়ুর মিলন অঞ্চলে সৃষ্ট মেরু জেট বায়ুর প্রভাবে ঘূর্ণবাত, বৃষ্টিপাত, তুষারপাত, বৃষ্টিপাতের বন্টন প্রভৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়।
২. নিম্ন অক্ষাংশের জলবায়ু
জেট বায়ুর জীবন চক্রের শেষ পর্যায়ে পরিতক্ত উষ্ণ বায়ুকক্ষ গুলি বায়ুমন্ডলের নিচের স্তরে এসে আরও শক্তিশালী হয় এবং সাইক্লোন, ঘূর্ণবাত, বৃষ্টিপাত প্রভৃতি সংঘটিত করে।
৩. মৌসুমী বায়ুর উপর প্রভাব
গ্রীষ্মকালে ক্রান্তীয় পূর্বালী জেট বায়ু আবির্ভাব হলে মৌসুমী বায়ুর আগমন হয়। উপক্রান্তীয় পশ্চিমা জেট বায়ু ভারতীয় উপমহাদেশে সক্রিয় হলে মৌসুমী বায়ু ফিরে যায়।
৪. উষ্ণতার সমতা
জেট বায়ুর জীবনচক্রে দেখা যায়, জেট বায়ুর তরঙ্গগুলি মেরু অঞ্চল থেকে ক্রান্তীয় অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। মেরু অঞ্চল থেকে শীতল বাতাসকে ক্রান্তীয় অঞ্চলে নিয়ে আসে এবং ক্রান্তীয় অঞ্চল থেকে উষ্ণ বাতাসকে মেরু অঞ্চলের দিকে নিয়ে গিয়ে পৃথিবীব্যাপী উষ্ণতার সমতা বজায় রাখে।
৫. বন্যা এবং খরা সৃষ্টি
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এবং বন্টন জেট বায়ুর উপর নির্ভর করে। এই কারণে বিভিন্ন স্থানে খরা এবং বন্যা সৃষ্টি পরোক্ষভাবে জেট বায়ুর উপর নির্ভরশীল।
৬. প্রতীপ ঘূর্ণবাত সৃষ্টি
জেট বায়ুর বাঁকের মধ্যে থাকা বায়ু কক্ষটি পরিত্যক্ত হয়ে ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন অঞ্চলে উপস্থিত হয়ে প্রতীপ ঘূর্ণবাতের সৃষ্টি করে।
৭. বিমান চলাচল
জেট বায়ু বিমান চলাচলকে নিয়ন্ত্রণ করে। বায়ুর দিকে বিমান চললে জ্বালানির সাশ্রয় হয় এবং বিপরীত দিকে বিমান চললে জ্বালানীর অপচয় হয়।
জিও স্টপিক বায় ু স্ট্রবেরি