Type Here to Get Search Results !

মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রক্রিয়া। হিউমিফিকেশন( Humification)। খনিজকরণ (Mineralisation)। এলুভিয়েশন (Eluviation)। ইলুভিয়েশন (Illuviation)। গ্লেইজেশন

       আবহবিকার এর প্রভাবে ভূত্বকের উপরের অংশ চূর্ণ-বিচূর্ণ এবং বিয়োজিত হয়ে যে আলগা শিলাস্তর গঠন করে তাকে রেগোলিথ বলে। জল, উষ্ণতা, শিলা গঠনকারী খনিজ, জৈব পদার্থ ও জীবজগতের পারস্পরিক ক্রিয়া বিক্রিয়ায় পরবর্তীকালে রেগোলিথ থেকে মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়। মৃত্তিকার সৃষ্টির এই প্রক্রিয়াকে পেডোজেনেসিস বলে। মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রক্রিয়াগুলিকে মূলত 3 ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- প্রাথমিক প্রক্রিয়া, মৌলিক প্রক্রিয়া, বিশেষ প্রক্রিয়া। 

ক) মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রাথমিক প্রক্রিয়া

        মৃত্তিকা বিজ্ঞানীগণ মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রাথমিক প্রক্রিয়াকে 4 ভাগে ভাগ করেছেন। যথা-

 ১. সংযোজন (Addition)  

        রেগোলিথ গঠিত হওয়ার পর তার সঙ্গে অক্সিজেন, জল, সৌরশক্তি, খনিজ এবং জৈব পদার্থের সংযোজন হয়।

 ২. অপসারণ (Loss) 

      সংযোজনের পর বাষ্পীভবনের মাধ্যমে মৃত্তিকা থেকে জল বেরিয়ে যায়। মৃত্তিকার উপর সঞ্চিত জৈব পদার্থ জারিত হয়ে তা থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে মিশে যায়। একে অপসারণ বা বর্জন বলে। 

 ৩. রূপান্তর ( Transformation) 

         অপসারণের পর মৃত্তিকায় থাকা খনিজ পদার্থ ভৌত ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় পরিবর্তিত হয় এবং গৌণ খনিজে রূপান্তর হয়। এছাড়া মৃত্তিকার জৈব পদার্থ হিমিফিকেশন এবং খনিজকরন প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হয়। এই প্রক্রিয়াকে একত্রে রূপান্তরিকরণ  বলে।

 ৪. স্থানান্তর (Translocation) 

       রূপান্তর প্রক্রিয়ার পর উৎপাদিত জৈব ও খনিজ পদার্থ জলের সঙ্গে দ্রবীভূত হয়ে অথবা ভাসমান অবস্থায় মৃত্তিকার অভ্যন্তরে স্থানান্তরিত হয়। এই প্রক্রিয়া এলুভিয়েশন এবং ইলুভিয়েশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কার্যকর হয়।


খ) মৌলিক প্রক্রিয়া 

          মৌলিক প্রক্রিয়াগুলি মূলত চার প্রকারের যথা

 ১. হিউমিফিকেশন     

          উদ্ভিদের দেহাবশেষ যেমন- মূল, কাণ্ড, পাতা, ফুল, ফল প্রভৃতি এবং প্রাণীর দেহবশেষ মৃত্তিকায় কাঁচা জৈব পদার্থ হিসেবে সংযুক্ত হয়। এই পদার্থগুলি সূক্ষ্ম জীবাণু দ্বারা পাচিত হয় এবং ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে এক অবিয়োজিত কালো রঙের পদার্থের সৃষ্টি করে। একে হিউমাস বলে। হিউমাস গঠনের প্রক্রিয়াকে হিউমিফিকেশন বলে।  

   বৈশিষ্ট্য 

     i) এটি হিউমাস সৃষ্টির একটি প্রক্রিয়া।  

     ii) রেগোলিথের সঙ্গে হিউমাস যুক্ত না হলে রেগোলিথকে মৃত্তিকা বলা যায় না। 

     iii) হিউমাস মৃত্তিকার জৈব পদার্থকে নিয়ন্ত্রণ করে। 

     iv) হিউমাস সৃষ্টির সময় খনিজকরণ প্রক্রিয়ায় মাটিতে বিভিন্ন খনিজলবণ যুক্ত হয়। 

     v) বিভিন্ন জলবায়ু অঞ্চলে হিউমিফিকেশন প্রক্রিয়ার হার ভিন্ন হয়।

 প্রকারভেদ 

       হিউমিকেশন প্রক্রিয়া মূলত চার প্রকার। যথা-

    i) অবায়ুজীবী হিমিফিকেশন    

              জলাশয়, পুকুর, হ্রদ, বিল প্রভৃতির তলদেশে বায়ুর অনুপস্থিতিতে অবায়ুজীবী জীবাণু দ্বারা জৈব পদার্থের বিশেষ ধরনের পচন ঘটে. একে অবায়ুজীবী হিমিফিকেশন বলে। 

            এই প্রক্রিয়ার সময় মিথেন, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং হাইড্রোজেন উৎপন্ন হয়। জলাশয়ে সৃষ্ট হিউমাস থেকে বগ, গ্লেই এবং পিট মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়।

    ii) আম্লিক হিউমিফিকেশন 

              শীত প্রধান অঞ্চলে যেখানে মাটিতে চুন জাতীয় পদার্থ বা অন্য পরিপোষকের অভাব রয়েছে, সেখানে যে হিউমিফিকেশন চলতে থাকে তাকে আম্লিক হিউমিফিকেশন বলে।

            এই অঞ্চলে সরলবর্গীয় এবং তুন্দ্রা উদ্ভিদ থেকে জৈব পদার্থ মাটিতে যুক্ত হয়। অত্যধিক ঠান্ডা থাকায় ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এই জৈব পদার্থের পচন হয় না। ফাঙ্গাস দ্বারা  জৈব পদার্থের পচন হয় বলে অম্লধর্মী জৈব পদার্থ সৃষ্টি হয়। এছাড়া এই অঞ্চলের মাটি সব সময় ভিজে থাকায় ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম প্রভৃতি ক্ষারকীয় পদার্থগুলি ধৌত প্রক্রিয়ায় মাটির নিচে চলে যায়।

     iii) উষ্ণ আর্দ্র ক্রান্তীয় অঞ্চলের হিমিফিকেশন  

               এটি নিরক্ষীয় ও ক্রান্তীয় অঞ্চলে হিউমার সৃষ্টির প্রক্রিয়া। বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রা বেশি থাকায় এই অঞ্চলে প্রচুর সংখ্যক গাছপালা জন্মায় ফলে মাটিতে কাঁচা জৈব পদার্থ বেশি পরিমাণ যুক্ত হয়। উষ্ণতা বেশি থাকায় জীবাণু অধিক কার্যকর হয়। ফলে খনিজকরণ প্রক্রিয়া বেশি হয় বলে এখানে হিউমাস কম পরিমাণ সৃষ্টি হয়। কিছু পরিমাণ জৈব পদার্থ জৈব জট হিসাবে স্থায়ীভাবে মাটির সঙ্গে মিশে থাকে।

    iv) মরুপ্রায় অঞ্চলের হিউনিফিকেশন 

             প্রেইরি, স্টেপ তৃনভূমি অঞ্চলে হিউমের সৃষ্টির প্রক্রিয়া। এখানে ঘাস বা তৃণ অধিক জন্মায় বলে মাটিতে অধিক পরিমাণ জৈব পদার্থ যুক্ত হয়। উষ্ণতা এবং বৃষ্টিপাত কম থাকায় বায়ুজীবী জীবাণু দ্বারা জৈব পদার্থ বিয়োজিত হতে পারেনা। ফলে মাটিতে অধিক পরিমাণ জৈব পদার্থ  সঞ্চিত হয় বলে মাটির রং কালো হয়।


 ২. খনিজকরণ (Mineralisation) 

                হিউমাস গঠনকারী খনিজ পদার্থ সমূহ, যেমন-  ফসফরাস, লোহা ইত্যাদি যে প্রক্রিয়ায় অক্সিজেনের উপস্থিতিতে জারিত হয়ে পুনরায় মৃত্তিকায় ফিরে আসে তাকে খনিজকরণ বলে। এটি হিউমিফিকেশনের ঠিক বিপরীত প্রক্রিয়া।


 ৩. এলুভিয়েশন (Eluviation)

                মাটির উপরের স্তরের খনিজ পদার্থ সমূহ দ্রবীভূত হয়ে অথবা ভাসমান অবস্থায় মাটির নিচের স্তরে স্থানান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে এলুভিয়েশন বলে। এলুভিয়েশন প্রক্রিয়া দুটি প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়। বিভিন্ন উপাদান যখন জলে ভাসমান অবস্থায় স্থানান্তরিত হয় তখন তাকে লেসিভেজ বলে। আবার জলে দ্রবীভূত অবস্থায় স্থানান্তরিত হওয়াকে ধৌত প্রক্রিয়া বলে। 

  বৈশিষ্ট্য 

     i) এলুভিয়েশন মৃত্তিকা সৃষ্টির একটি মৌলিক প্রক্রিয়া। 

     ii) এই প্রক্রিয়ার উপর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাব সবচেয়ে বেশি। 

     iii) মৃত্তিকার ওপরের স্তরে কার্যকর হয়। 

     iv) উপরিস্তর থেকে বিভিন্ন খনিজ এবং জৈব পদার্থ অপসারিত হয়। 

      v) খনিজ শূন্য হওয়ায় মৃত্তিকার উপরিভাগ ফ্যাকাসে হয়। 

     vi) মৃত্তিকার A স্তরে কার্যকর হয় বলে A স্তরকে অ্যালুভিয়াল স্তর বলে।


 প্রকারভেদ 

      i) যান্ত্রিক এলুভিয়েশন 

               উপরিয়স্তর থেকে পদার্থ সমূহ সরাসরি বা যান্ত্রিকভাবে নিচের স্তরে স্থানান্তরিত হয়।

     ii) রাসায়নিক এলুভিয়েশন

               বিভিন্ন খনিজ এবং জৈব অম্ল রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে অপসারিত হয়।

 ৪. ইলুভিয়েশন (Illuviation)

                 মৃত্তিকার উপরের স্তর থেকে দ্রবীভূত ও ভাসমান পদার্থ সমূহ মৃত্তিকার নিচের স্তরের সঞ্চিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে ইলুভিয়েশন বলে। এই প্রক্রিয়া মৃত্তিকার B স্তরে কার্যকর হয় বলে B স্তরকে ইলুভিয়াল স্তর বা ইলুভিয়েটেড হরাইজন বলে। 

    বৈশিষ্ট্য 

        i) এটি মৃত্তিকার মৌলিক প্রক্রিয়া। 

       ii) মৃত্তিকার কিছুটা গভীরে সঞ্চয় প্রক্রিয়া। 

       iii) এলুভিয়েশন প্রক্রিয়ার ওপর ইলুভিয়েশন প্রক্রিয়া নির্ভর করে। 

       iv) মৃত্তিকার নিচের স্তর খনিজ লবণ সমৃদ্ধ হয়। 

       v) মৃত্তিকার B স্তরে কার্যকর হয়। 

       vi) খনিজলবণ সমৃদ্ধ হওয়ায় B স্তরের রং গাঢ় হয়।


গ) বিশেষ প্রক্রিয়া বা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া (Specific Processes)

           বিভিন্ন ধরনের মৃত্তিকা সৃষ্টিতে বিভিন্ন প্রক্রিয়া কার্যকর হয়। সেগুলিকে বিশেষ প্রক্রিয়া বলে। এই ধরনের প্রক্রিয়াগুলি সব রকম পরিবেশের সক্রিয় হয় না। প্রক্রিয়াগুলি মূলত 6 প্রকার।

    i) ল্যাটেরাইজেশন    

            ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে ল্যাটেরাইজেশন বলে। উষ্ণ ও আর্দ্র অঞ্চলে এই প্রক্রিয়া কার্যকর হয়। উষ্ণতা এবং বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় ধৌত প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকার উপরের স্তর থেকে সিলিকা অপসারিত হয়। মৃত্তিকার উপরিস্তরে লোহা এবং অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড যুক্ত সেসক্যুই অক্সাইড (Sesquioxide) সঞ্চিত হয়। ফলে মৃত্তিকার রং লাল হয়। মৃত্তিকার উপরিভাগে অথবা ভূপৃষ্ঠের অল্প নিচে ইটের মত কঠিন শক্ত স্তর গঠিত হয়। একে ডিউরিক্রাস্ট (Duricrust) বলে।   

    ii) পডসলাইজেশন     

            শীতল ও আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চলে পডসল মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে পডসলাইজেশন বলে। উষ্ণতা কম থাকায় এই অঞ্চলের মাটিতে সারা বছর ধৌত প্রক্রিয়া কার্যকর হয়। ধৌত প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকার উপরিস্তর থেকে সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম,  লোহা, অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড প্রভৃতি অপসারিত হয় এবং উপরিভাগে সিলিকার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলে মাটি অম্লধর্মী হয়। অপসারিত পদার্থগুলি B  স্তরে সঞ্চিত হয়ে একটি  অদ্রবণীয় স্তর গঠন করে একে হার্ডপ্যান বলে। 

    iii) গ্লেইজেশন 

           যে সকল নিম্নভূমি বা জলাভূমিতে সর্বদা জল জমে থাকে, সেখানে মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে গ্লেইজেশন বলে। জল জমে থাকায় এখানে মাটিতে অক্সিজেনের জোগান থাকে না। ফলে জারণ প্রক্রিয়ার পরিবর্তে বিজারণ প্রক্রিয়া অধিক কার্যকর হয়।ফলে মাটির রং বাদামি না হয়ে ধূসর বা নীলাভ বাদামী হয়।  

    iv) ক্যালসিফিকেশন   

             প্রেইরি, স্টেপ প্রভৃতি নাতিশীতোষ্ণ তৃণভূমি অঞ্চলে মৃত্তিকা পরিলেখের কোন স্তরে চুন জাতীয় পদার্থ (Ca, Ca Co3) সঞ্চিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে ক্যালসিফিকেশন বলে। ক্যালসিয়াম সঞ্চয়ের ফলে মৃত্তিকার অল্প নিচে শক্তস্তর গড়ে ওঠে। একে ক্যালিচে বলে। চার্নোজেম, চেস্টনাট মৃত্তিকা এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়।

    v) স্যালিনাইজেশন 

            এটি মরু ও মরুপ্রায় অঞ্চলে লবণাক্ত মাটি (সোলোনচাক) গঠনের প্রক্রিয়া। মাটিতে Ca, Mg, Na এর লবণ সালফেট বা ক্লোরাইড রূপে সঞ্চিত হয়। মরু বা মরুপ্রায় অঞ্চল, সমুদ্রতীর এবং শুষ্ক অঞ্চলে এই প্রক্রিয়া সক্রিয় হয়।

    vi) অ্যালকালাইজেশন

           যে প্রক্রিয়ায় মাটিতে কর্দম বা কাদাকনা যৌগে সোডিয়াম আয়ন বেশি সঞ্চিত হয়ে মাটি ক্ষারধর্মী হয়ে পড়ে। তাকে অ্যালকালাইজেশন বা ক্ষারীয়করণ বলে। এই প্রক্রিয়া শুষ্ক মরু অঞ্চলে বেশি সক্রিয় হয়।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Ads Area