পৃথিবীর সব জায়গায় একই ধরনের মৃত্তিকা সৃষ্টি হয় না। কোথায় কি ধরনের মৃত্তিকা সৃষ্টি হবে তা নির্ভর করে মৃত্তিকা সৃষ্টির কারণ বা নিয়ন্ত্রকের ওপর। রাশিয়ার মৃত্তিকা বিজ্ঞানী ভি.ভি ডকুচেভ ( V. V. Dokuchaev )1883 সালে স্তেপ তৃণভূমি অঞ্চলে গবেষণা করার সময় মৃত্তিকা সৃষ্টির চারটি কারণের কথা বলেন।
তিনি মৃত্তিকা সৃষ্টির কারণ বা নিয়ন্ত্রক গুলিকে একটি সমীকরণের সাহায্যে প্রকাশ করেছিলেন। সমীকরণটি হল-
S = f ( Cl, O, P, T )
এখানে,
Cl = জলবায়ু
O = জীবজগৎ
P = আদিশিলা এবং
T = সময়
পরবর্তীকালে এইচ. এইচ. জেনি ডুকুচেভের মৃত্তিকা সৃষ্টির চারটি কারণের সঙ্গে আরেকটি কারণ যুক্ত করে মোট পাঁচটি কারণ বা নিয়ন্ত্রকের কথা বলেন।
মৃত্তিকা সৃষ্টির নিয়ন্ত্রক সমূহের এইচ. এইচ. জেনির দেওয়া সমীকরণটি হল-
S = f ( Cl, O, R, P, T )
এখানে,
Cl = জলবায়ু
O = জীবজগৎ
R =ভূপ্রকৃতি
P = আদি শিলা এবং
T = সময়
মৃত্তিকা সৃষ্টির এই পাঁচটি কারণ বা নিয়ন্ত্রক গুলিকে দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়।
1) সক্রিয় কারণ -
ক) জলবায়ু (Cl) এবং
খ) জীবজগৎ (O)
2) নিষ্ক্রিয় কারণ-
ক) ভূপ্রকৃতি (R),
খ) আদিশীলা (P) এবং
গ) সময়(T)
এই কারণগুলি সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে নিচে আলোচনা করা হলো।
1 ) সক্রিয় কারণ (Active Factors)
ক) মৃত্তিকা সৃষ্টিতে জলবায়ুর প্রভাব ( Climate)
মৃত্তিকা সৃষ্টির জন্য জলবায়ুর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। জলবায়ুর প্রভাব আলোচনা করার সময় অন্যান্য কারণগুলিকে স্থির ধরা হয়। জলবায়ুর প্রধান দুটি উপাদান হল বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রা। এই উপাদান দুটি জনশিলা বা আদি শিলার উপর কার্যকর হয়ে রেগোলিথ গঠন করে এবং পরবর্তীতে রেগোলিথের ওপর ক্রিয়া করে মৃত্তিকা পরিলেখ গঠন করে। নিচে মৃত্তিকা সৃষ্টিতে জলবায়ুর প্রধান দুটি উপাদান উষ্ণতা এবং বৃষ্টিপাতের প্রভাব আলোচনা করা হলো।
a) বৃষ্টিপাতের প্রভাব (Rainfall)
ভূপৃষ্ঠে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত পতিত হয় তার 15 থেকে 50 ভাগ বৃষ্টির জল মাটির নিচে চুইয়ে প্রবেশ করে। বৃষ্টিপাত মৃত্তিকা সৃষ্টিতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলির উপর প্রভাব ফেলে।
i) মৃত্তিকার গভীরতার উপর প্রভাব
বৃষ্টিপাত বেশি হলে মৃত্তিকার গভীরতা বেশি হয় এবং বৃষ্টিপাত কম হলে মৃত্তিকার গভীরতা কম হয়। নিরক্ষীয় অঞ্চলে এবং আর্দ্র নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে মৃত্তিকায় অধিক পরিমাণ জল থাকায় মৃত্তিকা যথেষ্ট গভীর হয়। অপরদিকে মরু অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় পরিলেখ গড়ে ওঠে না। ফলে মৃত্তিকার গভীরতা কম হয়।
ii) রাসায়নিক উপাদানের উপর
বৃষ্টিপাত বেশি হলে ধৌত প্রক্রিয়ায় ক্ষার জাতীয় পদার্থ মৃত্তিকার গভীরে স্থানান্তরিত হয়ে সঞ্চিত হয়। ফলে মৃত্তিকার উপরিভাগ খনিজ লবণের ঘাটতি দেখা দেয় এবং অম্লধর্মী হয়ে পরে। মরু অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় ক্ষারজাতীয় পদার্থ মৃত্তিকার উপরিভাগে সঞ্চিত হয়।
iii) খনিজ লবনের ওপর
অধিক বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চলে সহজ দ্রবণীয় পদার্থসমূহ যেমন- ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম যৌগ ধৌত প্রক্রিয়ায় বা দ্রবীভূত হয়ে অপসারিত হয়। কম বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চলে এগুলি মৃত্তিকার উপরি স্তরে সঞ্চিত হয়ে থাকে।
b) মৃত্তিকা সৃষ্টিতে তাপমাত্রার বা উষ্ণতার প্রভাব ( Temperature)
ভেন্ট হফের সূত্র অনুযায়ী প্রতি 10 ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে রাসায়নিক বিক্রিয়ার হার দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে যতই মেরুর দিকে যাওয়া যায় উষ্ণতা কমতে থাকায় রাসায়নিক বিক্রিয়ার হার কমতে থাকে। মৃত্তিকা সৃষ্টিতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলির উপর তাপমাত্রা প্রভাব ফেলে।
i) মৃত্তিকা গভীরতার উপর
অধিক তাপমাত্রা যুক্ত অঞ্চলে শিলা দ্রুত আবহবিকার দ্বারা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়। ফলে মৃত্তিকা গভীর হয়। কম তাপমাত্রা যুক্ত অঞ্চলে আবহবিকারের হার কম হওয়ায় মাটি কম গভীর হয়।
ii) জৈব পদার্থ এবং নাইট্রোজেনের পরিমাণ এর ওপর
অধিক তাপমাত্রা যুক্ত অঞ্চলে হিউমাস দ্রুত খনিজকরণ হয়। ফলে মাটিতে জৈব পদার্থ এবং নাইট্রোজেনের পরিমাণ কম হয়। কম তাপমাত্রা যুক্ত অঞ্চলে মাটিতে জৈব পদার্থ এবং নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেশি হয়।
iii) কর্দম খনিজের পরিমাণের ওপর
অধিক তাপমাত্রা যুক্ত অঞ্চলে রাসায়নিক বিক্রিয়ার হার বেশি হওয়ায় মূল খনিজ গৌণ খনিজ পরিণত হয় অর্থাৎ মৃত্তিকায় কর্দম খনিজের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
খ) মৃত্তিকা সৃষ্টিতে জীবজগতের প্রভাব ( Organism )
মৃত্তিকায় উপস্থিত জৈব পদার্থ মৃত্তিকা সৃষ্টির সক্রিয় কারণ। মৃত্তিকা সৃষ্টিতে জীবজগতের বা জৈব পদার্থের প্রভাব এতটাই বেশি থাকে যে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়। নাতিশীতোষ্ণ তৃণভূমি অঞ্চলে মৃত্তিকার উপরিভাগ জৈব পদার্থপূর্ণ হওয়ায় চার্নোজেম মৃত্তিকা্র সৃষ্টি হয়। যা মৃদু ক্ষারধর্মী। অন্যদিকে পাইন জাতীয় বনভূমি অঞ্চলে অম্লজাতীয় জৈব পদার্থ মাটিকে আম্লিক করে।
জৈব পদার্থের উপস্থিতি মাটির ভৌত ধর্মকে প্রভাবিত করে। যেমন-
- মাটির গঠনকে দৃঢ় করে।
- জলধারন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
- মাটির রং নির্ধারণ করে।
- মাটির ক্ষয় রোধ করে। জৈব পদার্থ মাটির কণাগুলিকে সঙ্ঘবদ্ধ করে গুটি তৈরি করে।
- মাটির ক্যাটায়ন বিনিময় হার বৃদ্ধি করে।
2 ) নিষ্ক্রিয় কারণ ( Passive Factors )
ক) মৃত্তিকা সৃষ্টিতে ভূপ্রকৃতির প্রভাব( Relief)
ভূপৃষ্ঠের ওপরে সব জায়গায় ভূমি ভাগের প্রকৃতি সমান নয়। কোথাও ভূমির ঢাল খাড়া হয়, কোথাও মাঝারি ঢাল যুক্ত হয় এবং কোথাও সমতল ভূমি হয়। এই সকল অঞ্চলগুলিতে মৃত্তিকার গভীরতা এবং গঠন ভিন্ন হয়। নিচের এই বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
i) সমতল ও প্রায় সমতল ভূমি
ভূমির ঢাল কম হওয়ায় এই অঞ্চলে জল গড়িয়ে যেতে পারে না। বেশি পরিমাণ জল মাটির সবচেয়ে গভীরে প্রবেশ করে। ফলে মাটির গভীরতা বেশি হয়।
ii) মাঝারি ঢাল যুক্ত ভূমি
মাঝারি ঢাল যুক্ত ভূমিতে খুব বেশি পরিমাণ জল মাটির গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে মাটির গভীরতা মাঝারি প্রকৃতির হয়। প্রবাহমান জলের সঙ্গে সূক্ষ্ম কর্দম কণা এবং জৈব পদার্থ দ্রবীভূত হয়ে অপসারিত হওয়ায় মাটি বালি এবং কাকর যুক্ত হয়।
iii) অধিক ঢাল যুক্ত ভূমি
ভূমির ঢাল খুব বেশি হলে বৃষ্টির জল ঢাল বরাবর দ্রুত অপসারিত হয়। খুব কম পরিমাণ জল মাটির গভীরে প্রবেশ করে ফলে মৃত্তিকা কম গভীর হয়। অধিক ঢাল যুক্ত ভূমিতে কোন কোন স্থানে মৃত্তিকা সৃষ্টি হওয়া সম্ভব হয়না।
খ) মৃত্তিকা সৃষ্টিতে আদি শিলার প্রভাব ( Parent Material / Rocks )
যে শিলা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পরবর্তীকালে মৃত্তিকা সৃষ্টি হয় তাকে জনক শিলা বা আদিশীলা বলে। আদিশীলার প্রকৃতির ওপর মাটির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নির্ভর করে যেমন
i) মৃত্তিকার অম্লত্ব এবং ক্ষারকত্ব
এটি মৃত্তিকা রাসায়নিক গুনাগুন। গ্রানাইট ও নিস শিলার মতো আগ্নেয় শিলায় সিলিকার পরিমাণ বেশি থাকে বলে মৃত্তিকা অম্লধর্মী হয়। ব্যাসল্ট এবং ডোলেরাইট শিলা ক্ষারধর্মী হওয়ায় এই শিলা থেকে সৃষ্ট মৃত্তিকা ক্ষারধর্মী হয়। তেমনি পেরিডোটাইট, সার্পেনন্টাইন থেকে অতি ক্ষারকীয় মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়।
ii) মৃত্তিকার রং
মৃত্তিকার রং মূল শিলার উপর বা আদি শিলার উপর নির্ভর করে। লোহা এবং ম্যাঙ্গানিজ সমৃদ্ধ মাটি থেকে লাল রঙের বা ল্যাটেরাইট মাটির উৎপত্তি হয়। মাটিতে কোয়ার্টজ এর পরিমাণ বেশি থাকলে মাটির রং হয় সাদা বা ধূসর। চুনাপাথর থেকে উৎপন্ন মাটি ধূসর হয়। একে রেনজিনা বলে।
iii) মাটির সৃষ্টির হার
জনক বা আদিশীলা অম্লধর্মী হলে আম্লিক মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়। এই মাটির গঠন সরল এবং দ্রুত সম্পন্ন হয়। আদিশিলা ক্ষারধর্মী হলে আম্লিক মৃত্তিকা সৃষ্টি বিলম্বিত হয়।
iv) শিলা খনিজের সঙ্গে মাটির সম্পর্ক
শিলায় কোয়ার্টজ খনিজ বেশি থাকলে তার থেকে সৃষ্ট মাটিতে বালির ভাগ বেশি হয় এবং ফেল্ডসপার খনিজের আধিক্য থাকলে কাদা কণার পরিমাণ বেশি হয়।
v) মাটির গঠন
মূল শিলা বা আদি শিলায় চুনের পরিমাণ বেশি হলে মাটির দানাগুলি দৃঢ়ভাবে সঘবদ্ধ হয় এবং মাটির গঠন কঠিন হয়। মাটিতে সোডিয়াম যৌগ বেশি থাকলে মাটির কণাগুলো বিচ্ছিন্ন হয় এবং মাটির গঠন দুর্বল হয়।
গ) মাটি সৃষ্টিতে সময়ের প্রভাব ( Time )
একটি পরিণত মাটির সৃষ্টি হতে গেলে কয়েক শত বছর বা কয়েক হাজার বছর সময় লাগে। মাটির সৃষ্টিতে সময়ের তারতম্যের কয়েকটি ভৌগোলিক কারণ আছে। যেমন-
i) আবহবিকারের হার
উষ্ণ ও আর্দ্র অঞ্চলে আবহবিকারের হার বেশি হওয়ায় মাটির দ্রুত সৃষ্টি হয়। আবার মেরু বা মরু অঞ্চলে আবহবিকারের হার কম হওয়ায় মাটি সৃষ্টির হার খুব ধীর।
ii) জনক শিলায় প্রকৃতি
জনক শিলার কাঠিন্যের ওপর মাটির সৃষ্টির সময় নির্ভর করে। যেমন- জনক শিলা কঠিন হলে মাটি ধীরগতিতে সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে কর্দমশিলা খুব সহজেই মাটিতে পরিণত হয়।
iii) পলি সঞ্চয়
যে সকল অঞ্চলে প্রতি বছর পলি সঞ্চিত হয় সেখানে কম পরিমাণ মাটির সৃষ্টি হয়।
iv) লোয়েস সঞ্চয়
যেখানে বায়ুর দ্বারা ধূলিকণা প্রতিনিয়ত সঞ্চিত হয়, সেখানে পরিণত মৃত্তিকা সৃষ্টি হয় না।
v) পর্বতের পাদদেশে প্রস্তরখণ্ড সঞ্চয়
পর্বতের পাদদেশে প্রতিনিয়ত ট্যালাস, ট্যালাস, স্ক্রী প্রকৃতি সঞ্চিত হয়। ফলে মাটি কখনো পরিণত হয় না।
vi) ভু আলোড়ন
কোন স্থান উত্থিত হলে মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়। কোন স্থান অবনমিত হলে মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রক্রিয়া দ্রুত হয় এবং অল্প সময়ে মৃত্তিকা পরিণত লাভ করে। যে সকল স্থান সুস্থির সেখানে পরিণত মৃত্তিকা গড়ে ওঠে।