বর্তমানে মহাদেশগুলিকে স্থির বলে মনে হয়। আবহবিদ আলফ্রেড ওয়েগনার বলেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশগুলি বিভিন্ন জলবায়ু অঞ্চলকে অতিক্রম করে বর্তমান অবস্থানে পৌঁছেছে। 1912 সালে তিনি তার মতবাদটি উত্থাপন করেন। পরে 1922 সালে জার্মানি ভাষায় তার বই "Die Entstehung der Kontinente Und Ozeane" ( মহাদেশ এবং মহাসাগরের উৎপত্তি) প্রকাশিত হয় । এর ইংরেজি অনুবাদ ( The Origin of the Continents and Oceans ) 1924 সালে প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে মহীসঞ্চরণ মতবাদ বিজ্ঞানী সমাজে এক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
মতবাদ
ওয়েগনারের মতে পার্মিয়ান যুগে মহাদেশীয় ভূ-খণ্ড গুলি মিলিতভাবে একক ভূ-খণ্ড রূপে দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থান করত। ওয়েগনার এই একত্রিত ভূখণ্ডকে প্যানজিয়া বলেছেন। যার অর্থ "সমগ্র ভূখণ্ড"। এই সময় দক্ষিণ মেরু ৪৫ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমা রেখা এবং ৫০ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষরেখার সংযোগ স্থানে অবস্থান করতো।একক ভূ-খণ্ডের উত্তরে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়া দ্বারা গঠিত অংশকে লরেশিয়া বা আঙ্গারাল্যান্ড নামে পরিচিত।প্যানজিয়ার দক্ষিণে দক্ষিণ আমেরিকা, উপদ্বীপীয় ভারত, অস্ট্রেলিয়া এবং আন্টার্টিকা দ্বারা গঠিত অংশ গন্ডোয়ানাল্যান্ড নামে পরিচিত। লরেশিয়া এবং গন্ডোয়ানাল্যান্ড এর মধ্যবর্তী অগভীর সামুদ্রিক অংশকে টেথিস বলা হয়। প্যানজিয়ার চারপাশের বিশাল জলভাগকে প্যানথালাসা বলে।
ওয়েগনারের মতে মেসোজোয়িক যুগের শুরুতে প্যানজিয়া ভেঙে গিয়ে বিভিন্ন দিকে সঞ্চারিত হতে থাকে। উত্তর আমেরিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকা পশ্চিম দিকে সঞ্চারিত হয় এবং আটলান্টিক মহাসাগর সৃষ্টি করে। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা উত্তর দিকে সঞ্চিত হয়। অস্ট্রেলিয়া পূর্ব দিকে সঞ্চারিত হয় এবং ভারত মহাসাগর সৃষ্টি করে। এই সময় আন্টার্টিকা দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে থেকে যায়। সঞ্চারনের পর অবশিষ্ট জলভাগ বা প্যানথালাসা প্রশান্ত মহাসাগর রূপে অবস্থান করে।
ওয়েগনারের মতে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা পশ্চিম দিকে সঞ্চারিত হওয়ার সময় বাঁধা পেয়ে রকি এবং অন্দিজ পর্বতমালা গঠন করে। ইউরোপ এবং আফ্রিকা কাছে চলে আসায় আল্পস পর্বত, উপদ্বীপীয় ভারত এবং এশিয়া কাছে চলে আসায় হিমালয় পর্বতের সৃষ্টি হয়েছে।
মহীসঞ্চরণের কারণ
১. বৈষম্যমূলক অভিকর্ষজ বল
পৃথিবী অভিগত গোলক হওয়ায় মহাদেশের ওপর পৃথিবীর অভিকর্ষ বল এবং প্লবতা বল একই সরলরেখার কার্যকর হয় না বরং প্লবতা বল নিরক্ষরেখার ওপর বেঁকে যায়। ফলে মহাদেশগুলির ওপর এক অতিরিক্ত বল ক্রিয়া করে। একে বৈষম্যমূলক অভিকর্ষজ বল বলে। এই বলের ফলে মহাদেশগুলি নিরক্ষীয় অঞ্চলের দিকে সঞ্চারিত হয়।
২. জোয়ারী বল
চন্দ্র ও সূর্যের আকর্ষণে সমুদ্রে জোয়ার হয়। এছাড়া পৃথিবী পশ্চিম থেকে পূর্বে আবর্তন করে। এই দুটি বলের মিলিত প্ৰভাবে সমুদ্র মহাদেশগুলির উপর বল প্রয়োগ করে। ফলে মহাদেশগুলি পশ্চিম দিকে সঞ্চারিত হয়।
৩. মহীসঞ্চরণের তৃতীয় শক্তি মহীসঞ্চরণের
শেওয়েডার ( Schweder) এর মতে মহাদেশগুলির আবর্তন অক্ষ সমগ্র পৃথিবীর আবর্তন অক্ষর থেকে আলাদা। ফলে মহাদেশগুলি শুধু পশ্চিম দিকে নয় নিরক্ষীয় অঞ্চলের দিকে সঞ্চারিত হয়।
মহীসঞ্চরণের প্রমাণ
1. জিগ- স- ফিট
কঠিন বস্তু ভেঙে গেলে যেমন জোড়া লেগে যায়, আটলান্টিক মহাসাগরের বিপরীত উপকূল রেখার মধ্যে ওয়েগনার সেরকম জোর লক্ষ্য করেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ব্রাজিলের রক অন্তরীপ গিনি উপসাগরে এবং পশ্চিম আফ্রিকার স্থিত অংশ মেক্সিকো উপসাগরে জোড়া লাগানো যায়। ওয়েগনারের মতে মহাদেশগুলি আগে একত্রিত থাকলেও পরবর্তীকালে মহীসঞ্চরনের ফলে মহাদেশগুলি বিচ্ছিন্ন হয়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছে।
2. ভূ-তত্ত্বীয় সূত্র
আটলান্টিক মহাসাগরের দুপাশের মহাদেশগুলিতে তিনি ভূ-তত্ত্বীয় সাদৃশ্য খুঁজে পান। এখানে তিনি অ্যাপালেশিয়ান পর্বতের কথা উল্লেখ করেন।এই পর্বতের হার্সেনিয়ান যুগের ভাঁজ ক্যালিডোনিয়ান যুগের ভাঁজকে ছেদ করে। ছেদ করার পর ক্যালিডোনিয়ান যুগের ভাঁজ হার্সেনিয়ান যুগের ভাঁজের উত্তরে অবস্থান করে। আটলান্টিক মহাসাগরের অপর পাড়ে ইউরোপ মহাদেশে ক্যালিডোনিয়ান যুগের ভাঁজ সব সময় হার্সেনিয়ান যুগের ভাঁজের উত্তরে অবস্থান করে। এছাড়া পূর্ব গ্রিনল্যান্ডেও ক্যালিডোনিয়ান যুগের ভাঁজ রয়েছে। ভূ-তত্ত্বীয় এই প্রমাণ ইউরোপ, গ্রিনল্যান্ড এবং উত্তর আমেরিকা মহাদেশের একত্র অবস্থানের পক্ষে যুক্তি দেয়।
3. প্রাচীন জলবায়ুর সূত্র
ওয়েগনারের মতে কোন একটি অঞ্চল বিভিন্ন ভূ-তত্ত্বীয় যুগে বিভিন্ন জলবায়ুর সম্মুখীন হয়েছে এবং বর্তমানে তার অনেক নিদর্শন পাওয়া গেছে। উত্তর আমেরিকার পার্মিয়ান কার্বোনিফেরাস যুগের কয়লা থেকে বোঝা যায় যে ওই সময় ওই অঞ্চলে নিরক্ষীয় অঞ্চলের মতো জলবায়ু ছিল। পরবর্তীকালে প্রায় একই স্থানে পাললিক শিলাস্তরের সঙ্গে লবণের স্তর দেখা যায়, যা শুষ্ক জলবায়ুকে নির্দেশ করে। এর থেকে বলা যায় উত্তর আমেরিকা মহাদেশ প্রথমে নিরক্ষীয় অঞ্চলে পরে ক্রান্তীয় অঞ্চলে এবং বর্তমানে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে সঞ্চারিত হয়েছে।
4. পুরাজীবীয় সূত্র
পার্মিয়ান কার্বোনিফরাস যুগে সঞ্চিত গণ্ডশিলা যুক্ত স্তরের মধ্যে গ্লসপটেরিস নামক ফার্ন জাতীয় এক ধরনের উদ্ভিদের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। ভারত, দক্ষিণ আমেরিকা, আন্টার্কর্টিকা এবং অস্ট্রেলিয়ায় এই ধরনের জীবাশ্ম পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে ক্যাঙ্গারু জাতীয় প্রাণী অস্ট্রেলিয়ায় প্রচুর সংখ্যায় দেখা যায়। শুধুমাত্র দক্ষিণ আমেরিকার চিলিতে জীবিত ক্যাঙ্গার এবং এই মহাদেশের অন্যত্র এদের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। এই ঘটনা দক্ষিণ গোলার্ধের মহাদেশগলির একত্র অবস্থানের পক্ষে যুক্তি দেয়।
5. হিমবাহের অবস্থান
দক্ষিণ আমেরিকা, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি স্থানে হিমবাহের প্রাচীন অবক্ষেপের নিদর্শন পাওয়া গেছে। ভূবিজ্ঞানীরা মনে করেন পর্মিয়ান যুগ থেকে কর্বোনিফেরাস উপযুগে (34-28 কোটি বছর আগে) মহাদেশের অংশগুলি শীতল জলবায়ুর অন্তর্গত ছিল। মহাদেশের সঞ্চরণের মাধ্যমে ভূ-খণ্ড গুলি বর্তমানে ভিন্ন ভিন্ন জলবায়ু অঞ্চলে অবস্থান করে।
6. মেরু সরণ ( Polar wandering)
ওয়েগনারের মতে মহাদেশের সঞ্চরণের সাথে পৃথিবীর উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরুর স্থানান্তর হয়। পুরা চুম্বকের গবেষণা থেকে যে তথ্য পাওয়া যায় সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন যুগে মেরুর অবস্থানের কথা জানা যায়।অবস্থানগুলি যোগ করে মেরুভ্রমণ রেখা পাওয়া যায়। এর থেকে মহাদেশগুলির সঞ্চরণ বোঝা যায়।
মহীসঞ্চরণ মতবাদের সমালোচনা
১. প্রদর্শিত বল প্রসঙ্গ
মহীসঞ্চরনের জন্য প্রয়োজনীয় বল ওয়েগনার প্রদর্শিত জোয়াড়ি বল থেকে 1000 গুন বেশি হওয়া প্রয়োজন। বৈষম্যমূলক অভিকর্ষজ বলের প্রভাবে মহাদেশগুলি নিরক্ষীয় অঞ্চলে একদেশীভবন হওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
২. জিগ-স-ফিট প্রসঙ্গ
আপাতদৃষ্টিতে আটলান্টিক মহাসাগরের বিপরীত তীর যতটা নিখুঁত মনে হয়, প্রকৃতপক্ষে মহাদেশের প্রান্ত ভাগের যথেষ্ট বিকৃতি ঘটিয়ে এই জোড় দেওয়া সম্ভব। অনেকের মতে এই জোড় দেওয়ার প্রসঙ্গটি ওয়েগনার অযথা অধিক বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
৩. পর্বত গঠন সংক্রান্ত
ওয়েগনারের মতে আমেরিকা মহাদেশ পশ্চিম দিকে সিমার (SiMa) উপর দিয়ে সঞ্চারিত হওয়ার সময় বাধা পেয়ে রকি ও আন্দিজ পর্বত সৃষ্টি হয়েছে। ইউলিশের মতে সিয়াল ( SiAl ) থেকে সীমার দৃঢ়তা বেশি। এই কারণে রকি ও আন্দিজ পর্বত গঠন নিয়ে তিনি প্রশ্ন করেন।
৪. প্রদর্শিত দিক এবং সময় প্রসঙ্গ
বর্তমান সময়ে কেউই ওয়েগনারের ধারনা অনুযায়ী সরল উত্তর ও পশ্চিম দিকে মহাদেশের সঞ্চারণ সমর্থন করেন না। পরবর্তীকালে যে গবেষণা হয়েছে তা স্পষ্ট ভাবে তার সত্য উৎঘাটন করেছে। এক্ষেত্রে গিলবার্ট এর মত অধিক গ্রহণযোগ্য।
৫. জীবাশ্মের বিস্তৃতির বিষয়
লেক (Lake) এর মতে দক্ষিণ ভারত, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, আন্টার্কর্টিকা ও অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও উত্তর কাশ্মীর, উত্তর-পশ্চিম আফগানিস্থান, সাইবেরিয়া প্রভৃতি স্থানে গ্লসপটেরিসের জীবাশ্ম পাওয়া যায়।
৬. সূচনা সময় সংক্রান্ত জটিলতা
কার্বোনিফেরাস যুগে মহাদেশগুলি কেন একত্রে ছিল এবং পরবর্তী কালে কেনো এবং কিভাবে ভাঙল সে বিষয়ে ওয়েগনার কিছু বলেননি।
৭. পলল সঞ্চয় সংক্রান্ত বিষয়
অনেকের মতে পলল স্তর সম্পর্কে যুক্তি দিয়ে ওয়েগনার তার তত্ত্বকে অনেক লঘু করেছেন।
৮. মেরু ভ্রমণ
মেরু ভ্রমণ সংক্রান্ত বিষয় অনেক ভূ-পদার্থ বিজ্ঞানী মেনে নিতে পারেননি।