মাটি ক্ষয়ের ফলাফল বা মৃত্তিকা ক্ষয়ের প্রভাব
মাটি বা মৃত্তিকা ক্ষয়ের দুই ধরনের ফলাফল দেখা যায়। যথা,-
ক) প্রত্যক্ষ ফলাফল
মাটি ক্ষয়ের ফলে প্রত্যক্ষভাবে বা সরাসরিভাবে প্রভাব বিস্তার করে যে বিষয়গুলি সেগুলি হল,-
১. উর্বর মাটির অপসারণ
মাটির উপরের স্তরে সবচেয়ে উর্বর মাটি থাকে। উপরের স্তরের এই জৈব এবং খনিজ পদার্থ সমৃদ্ধ মাটি অপসারিত হলে মাটির উর্বরা শক্তি কমে যায়। একটি হিসেবে দেখা গেছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছরে প্রায় 30 কোটি টন মাটি অপসারিত হয়।
২. কৃষিজমির গুণমান হ্রাস
মাটির উপরের স্তর ক্ষয়প্রাপ্ত হলে এবং ক্ষয়প্রাপ্ত পদার্থ কৃষিজমিতে জমা হলে কৃষিজমি চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এর ফলে কৃষি উৎপাদন কমে যায়।
৩. গাছের পুষ্টি মৌলের অভাব
মাটি ক্ষয়প্রাপ্ত হলে উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি মৌল NPK এবং অনুখাদ্য গুলি ( লোহা (Fe), বোরন(B), মলিবডেনাম(Mo), জিংক(Zn) ইত্যাদি ) অপসারিত হয়ে যায়। ফলে মাটিতে পুষ্টি মৌলের অভাব দেখা যায়।
৪. জলাশয় ভরাট
ক্ষয়প্রাপ্ত মাটি এবং বালির কণাগুলি জলধারা এবং বায়ুবাহিত হয়ে ছোট বড় জলাধারে সঞ্চিত হয়। এর ফলে জলাধারগুলি মজে যায় এবং জলধারণ ক্ষমতা কমে গেলে কম বৃষ্টিতেই জলাশয়গুলি ভরাট প্রাপ্ত হয়। ফলে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে প্লাবন দেখা দেয়।
খ) পরোক্ষ ফলাফল
১. বন্যার প্রকোপ বৃদ্ধি
মৃত্তিকার উপরিস্তর ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ক্ষয়জাত পদার্থগুলি নদীর তলদেশে সঞ্চিত হলে নদীখাতের গভীরতা কমে যায়। ফলে নদীর জলধারণ ক্ষমতাও কমে যায়। বর্ষাকালে অতিরিক্ত জল নদীতে এসে পড়লে দুকূল ছাপিয়ে বন্যা দেখা দেয়।
২. চড়া সৃষ্টি
ক্ষয়প্রাপ্ত পলি, বালি, কাদা প্রভৃতি সঞ্চয়ের ফলে নদী, হ্রদ বা জলাশয়ে চড়া সৃষ্টি হয়। নদীতে চড়া সৃষ্টি হলে নদীর গভীরতা কমে যায়। এর ফলে বন্যার প্রকোব বৃদ্ধি পায়। চড়াগুলি নৌপরিবহনে বাধার সৃষ্টি করে।
৩. জলের ঘনত্ব এবং স্বচ্ছতার উপর প্রভাব
মাটি ক্ষয়ের ফলে পলি, বালি, কাদা নদীর জলে বেশি পরিমাণে থাকলে নদীর জলের ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। ফলে জল ঘোলাটে এবং অস্বচ্ছ হয়। এই জল বিদ্যুৎ তৈরির কাজে লাগে না।
৪.মাটিতে জলের প্রবেশ্যতা হ্রাস
মাটি ক্ষয়ের ফলে উপরিভাগের আলগা পদার্থ অপসারিত হয়।নিচের কঠিন স্তর উপরে উঠে আসে। কঠিন স্তরের উপর দিয়ে জল প্রবাহিত হলে জল চুঁইয়ের নিচে যেতে পারে না।ফলে জলের প্রবেশ্যতা কমে যায়। এর ফলে ভৌমজলের পরিমাণও কমে যায়।
৫. জলধার ভরাট
অনেক সময় নদীতে বাঁধ দিয়ে জলাধার তৈরি করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে ক্ষয়জাত পদার্থ সঞ্চিত হয়ে জলাধারগুলি ভরাট হয়ে যায়। ফলে জলাধারের জলধারণ ক্ষমতা কমে যায়।
৬. দূষণ
বায়ুর মাধ্যমে অতি সূক্ষ্ম মাটির কণাগুলি বায়ুতে মিশে ভাসমান অবস্থায় থাকে। এই ভাসমান মাটির কণাগুলি ভূপৃষ্ঠে সূর্য রশ্মির প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে। এছাড়া এই কণাগুলি বায়ুদূষণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই ভাসমান কণাগুলো রাসায়নিক বিক্রিয়া করে থাকে।
৭. বায়ুর স্বচ্ছতা হ্রাস
বায়ুবাহিত মাটির কণাগুলো বাতাসে ভাসমান অবস্থায় থাকলে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে। যা বিমান চলাচলে বাধা দেয়।
৮. অন্যান্য প্রভাব
মাটির সঙ্গে কীটনাশক এবং অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্যবাহিত হয়ে জলে মিশে একদিকে যেমন জলকে দূষিত করে তেমনি মাটির উর্বরাশক্তি কমায়।
মৃত্তিকা সংরক্ষণের উপায় সমূহ
বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে মাটিকে ক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করা এবং ভবিষ্যতের জন্য মাটির উর্বর শক্তি বজায় রাখাই হলো মাটি সংরক্ষণের প্রধান উদ্দেশ্য। মাটি সংরক্ষণের উপায়গুলিকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়,-
ক) জীব সম্পর্কিত পদ্ধতি
এক্ষেত্রে জৈব পদার্থ, জৈব সার এবং গাছপালার সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে মাটি সংরক্ষণ করা হয়। যেমন,-
১. রেখা বরাবর শস্য চাষ
ঢালু জমিতে জলের গতি বেশি থাকার জন্য মাটি ক্ষয় বেশি হয়। এই অঞ্চলে ঢালের আড়াআড়ি দিকে চওড়া ফিতের মত জমি তৈরি করে ক্ষয় প্রতিরোধকারী অনুকূল শস্য যেমন- সিম, সয়াবিন, চিনাবাদাম, ডাল প্রভৃতি চাষ করা হয়। এই সকল শস্য ঢাল বরাবর জলের প্রবাহকে যেমন বাধা দেয় তেমনি মাটির জলধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
২. শস্যাবর্তন
শস্যাবর্তন এবং আন্ত:কৃষির মাধ্যমে দানাশস্য, ধান, গম, তামাক, আলু প্রভৃতি ঘনভাবে চাষ করলে মাটির উর্বরতা বজায় রাখা যায়।
৩. মাটি আচ্ছাদনকারী শস্য চাষ
ঘাস, বিনস, চিনাবাদাম প্রভৃতি মাটি আচ্ছাদনকারী শস্য চাষ করলে মাটির উর্বরতা বজায় থাকে। এই সকল শস্য বৃষ্টির জলের আঘাত থেকে মাটির কণাগুলিকে রক্ষা করে এবং মাটির পৃষ্ঠ বরাবর জল প্রবাহকে বাধা দেয়।
৪. জৈব সারের ব্যবহার
মাটিতে জৈব সারের মিশ্রণ প্রয়োগ করলে মাটির গঠনকে উন্নত করে। যা মাটির মধ্যে জলের প্রবেশ্যতাকে বাড়ায় এবং মাটির ক্ষয় কম করে।
৫. মালচিং
শস্যের অবশিষ্টাংশ, শিকড় প্রভৃতি দ্বারা জমিকে ঢেকে রাখলে বায়ুপ্রবাহের দ্বারা মাটির ক্ষয়কে রোধ করা যায়।
৬. পশুচারণ নিয়ন্ত্রণ
তৃণভূমিগুলি ভূপৃষ্ঠের উপর দিয়ে প্রবাহিত জলকে বাধা দেয়। ফলে মৃত্তিকা ক্ষয় কম হয়। এই কারণে তৃণভূমি অঞ্চল গুলিতে পশুচারণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
খ) যান্ত্রিক পদ্ধতি
ভূ-পৃষ্ঠ বরাবর জলের প্রবাহ এবং বায়ুর প্রবাহকে কমানোর ক্ষেত্রে কিছু যান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা প্রয়োজন। যান্ত্রিক পদ্ধতিগুলি জৈব পদ্ধতির সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে মৃত্তিকা ক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করে।যেমন,-
১. সমোন্নতি রেখা বরাবর চাষ
ঢালু অঞ্চলে একই উচ্চতা যুক্ত স্থানগুলিকে যুক্ত করলে যে কাল্পনিক রেখা পাওয়া যায় তাকে সমোন্নতি রেখা বলে। এই রেখা বরাবর আল বা বাঁধ দিলে ঢাল বরাবর জলের গতিকে বাধা দেয় এবং বেশি পরিমাণ জল মাটিতে প্রবেশ করে। ফলে ঢালু অঞ্চলে যে সকল উদ্ভিদ রোপন করা হয় সেগুলি প্রয়োজন মতো জল পায়। পরপর দুটি বাঁধের দূরত্ব জমির ঢালের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে।
২. ধাপ চাষ
ঢালু অঞ্চলে মাটি কেটে ধাপ সৃষ্টি করা হয়। এই ধাপ জলের প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে মাটির ক্ষয় কম করে। পরপর অসংখ্য সংকীর্ণ ধাপ তৈরি করে পর্বতের পাদদেশীয় ঢালে শস্য চাষ করা হয়।
৩. ভূমির ঢাল বরাবর গর্ত বা খাত নির্মাণ
ঢালু অঞ্চলে অসংখ্য গর্ত বা খাত তৈরি করলে জলের গতি বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং মাটির ক্ষয় কম হয়।
৪. জলাশয় নির্মাণ
পুকুর বা জলাশয় নির্মাণ করলে বর্ষার অতিরিক্ত জল এই জলাশয়গুলিতে সঞ্চিত হয়। ফলে মাটি ক্ষয়ের প্রবণতা কম হয়।
৫. বায়ুর গতিপথে বাধার সৃষ্টি
শুষ্ক অঞ্চলে বায়ুর গতিপথে গাছপালা রোপণ করে বায়ুর গতিকে বাধা দিয়ে বায়ুর দ্বারা মৃত্তিকা ক্ষয় নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
৬. নদীর পাড়ের ক্ষয় রোধ
নদীর পাড়গুলিতে ঘাস বা গাছ রোপন করতে হবে, যাতে নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের মাটিকে গাছগুলি তার শিকড়ের সাহায্যে ধরে রাখে। এছাড়া নদীর আড়াআড়ি ভাবে জেটি নির্মাণ করে জলের গতিকে কমিয়ে মাটি ক্ষয় রোধ করা যায়।
৭. বনভূমি সৃষ্টি করা
পতিত জমি বা পাহাড়ের ঢালে বনভূমি সৃষ্টি করে মৃত্তিকা ক্ষয় প্রতিরোধ করা যায়।
৮. তৃণভূমি সৃষ্টি করা
যে সকল জমিতে ক্রমাগত ভূমিক্ষয় হয় সেখানে শস্য কাটার পর পতিত জমিতে কৃত্রিমভাবে ঘাস চাষ করে আচ্ছদন সৃষ্টি করা যেতে পারে। এর ফলে জমি ফাঁকা থাকে না। পরবর্তীকালে চাষের সময় এই তৃণ জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করে।