ক) মৃত্তিকার উর্বরতা কি?
মৃত্তিকার উর্বরতা বলতে মাটির এক বিশেষ গুণকে বোঝায়, যা উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি পদার্থগুলি সুষম পরিমাণে সরবরাহ করতে সক্ষম। উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি মৌলগুলির প্রাপ্তির ওপর মাটির উর্বরতা নির্ভরশীল।
উর্বরতার বৈশিষ্ট্য
- মৃত্তিকার উর্বরতা মৃত্তিকার গ্রথনের ওপর নির্ভরশীল।
- মৃত্তিকার উর্বরতা উৎপাদন ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল নয়।
- মৃত্তিকায় সমস্ত প্রকার উদ্ভিদ চাষ করা যাবে তার নিশ্চয়তা নেই।
মৃত্তিকার উর্বরতার শ্রেণীবিভাগ
মাটির উর্বরতা দুই ধরনের হয়। যথা,
i) সহজাত বা অন্তর্নিহিত উর্বরতা
কোন উদ্ভিদ খাদ্য বাইরে থেকে প্রয়োগ না করলেও স্বাভাবিকভাবে মাটির উর্বরতা বজায় থাকে, একে সহজাত উর্বরতা বলে। উদ্ভিদের সুষম বৃদ্ধি এবং পুষ্টির জন্য নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পটাশিয়াম একান্ত প্রয়োজন। ভারতের সমস্ত মাটিতে এই পুষ্টি মৌলগুলি সুষম ভাবে পাওয়া যায় না। সহজাত উর্বরতার একটি নির্দিষ্ট সীমা থাকে।
ii) অর্জিত উর্বরতা
জলসেচ, জমি কর্ষণ, বিভিন্ন ধরনের সার প্রয়োগের মাধ্যমে মাটির যে উর্বরতা সৃষ্টি করা হয় তাকে অর্জিত উর্বরতা বলে। বেশি পরিমাণ সার দিলেও উর্বরতা যত খুশি বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। অর্জিত উর্বরতার একটা সীমা থাকে।
মাটির উর্বরতার নিয়ন্ত্রক
মাটির উর্বরতা একটি প্রাকৃতিক বিষয়। যা কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে। এই বিষয়গুলি বা নিয়ন্ত্রকগুলি নিম্নে আলোচিত হলো-
১. মৃত্তিকার গ্রথন
মৃত্তিকায় বালির ভাগ বেশি থাকলে জল সহজে প্রবেশ করতে পারে, কিন্তু জল ধরে রাখতে পারেনা। আবার কাদাকণার পরিমাণ বেশি থাকলে জল ধরে রাখতে পারে, কিন্তু বায়ু চলাচল করতে পারে না। এই কারণে যে মাটিতে কাদা এবং বালির পরিমাণ প্রায় সমান সেই মাটির জলধারণ ক্ষমতা এবং বায়ু চলাচল ক্ষমতা আদর্শ হওয়ায় উর্বরতা বেশি হয়।
২. মাটির গঠন
মাটির কণাগুলো সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে গঠন সৃষ্টি করলে তার মধ্যে জল প্রবেশ, বায়ু চলাচল, তাপমাত্রার আদান-প্রদান, মাটির সছিদ্রতা, উদ্ভিদের মূলের প্রবেশ ইত্যাদি সহজ হয়। ফলে গঠনযুক্ত মাটি উর্বর হয়।
৩. মাটির গভীরতা
সব অঞ্চলের মাটি সমান গভীর হয় না। A এবং B স্তরের মধ্য থেকে উদ্ভিদ তার শিকড়ের সাহায্যে খনিজ লবণ সংগ্রহ করে। A এবং B স্তর গভীর হলে সেই মাটি উর্বর হয়।
৪. মাটির সছিদ্রতা
মাটির কণাগুলোর মধ্যে যে ফাঁকা স্থান থাকে তাকে মাটির রন্ধ্র বলে। এই রন্ধ্রের মধ্যে বাতাস এবং জল থাকে। রন্ধ্রযুক্ত মাটি অধিক উর্বর হয়। কারণ এখান থেকে উদ্ভিদ প্রয়োজনীয় জল এবং খনিজ লবণ সংগ্রহ করে।
৫. মাটির তাপমাত্রা
বিভিন্ন তাপমাত্রাযুক্ত অঞ্চলে বিভিন্ন রকমের উদ্ভিদ জন্মায়। সূর্যের তাপ মাটির তাপমাত্রার প্রধান উৎস। উদ্ভিদ সরাসরি সূর্য থেকে যেমন তাপ সংগ্রহ করে তেমনি সূর্যের তাপের প্রভাবে মৃত্তিকা আবহবিকার গ্রস্ত হয় এবং মৃত্তিকার মধ্যে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া সম্পাদিত হয়। ফলে মৃত্তিকায় খনিজ পদার্থের উপস্থিতি উষ্ণতা বা তাপের উপর নির্ভর করে। একারণে যথাযথ উষ্ণতা বা তাপমাত্রা উদ্ভিদের বৃদ্ধি এবং বিকাশের পক্ষে আদর্শ।
৬. মাটির আর্দ্রতা
কম আর্দ্রতা যুক্ত অঞ্চলে উদ্ভিদ তার প্রয়োজনীয় খাদ্য মৌল মাটি থেকে সংগ্রহ করতে পারেনা। মাটিতে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি হলে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়ামের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলে আর্দ্রতা মৃত্তিকার উর্বরতার একটি নিয়ন্ত্রক।
৭. মৃত্তিকার বায়ু
মাটির মধ্যে থাকা রন্ধ্রগুলির মধ্যে বায়ু এবং জল থাকে। মৃত্তিকার মধ্যে অবস্থিত কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং অক্সিজেন উদ্ভিদের বিভিন্ন জৈবনিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রন করতে সহায়তা করে। একারণে বায়ুমণ্ডল এবং মৃত্তিকার মধ্যের বাতাস আদান-প্রদান হলে সেই মাটি তত উর্বর হয়।
৮. মাটির জল
মাটির কণার মধ্যে থাকা ফাঁকা জায়গায় যে জল থাকে তার মধ্যে বিভিন্ন খনিজ পদার্থগুলো দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। উদ্ভিদ তার প্রয়োজনীয় খনিজগুলি এই জলের মধ্যে দ্রবীভূত খনিজ থেকে সংগ্রহ করে। একারণে মৃত্তিকার জল উর্বরতার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রক।
৯. মাটিকর্ষণ
মাটিকর্ষণ করলে মাটির মধ্যে জল এবং বায়ুচলাচল ভালো হয়। ফলে সেই মাটি খুব উর্বর হয়।
১০. মৃত্তিকার বিক্রিয়া
মাটির বিক্রিয়া pH দ্বারা প্রকাশ পায়। pH এর মান নিরপেক্ষ হলে তা উৎকৃষ্ট হয়, কারণ এইরূপ মাটিতে অধিক পরিমাণে ক্ষারীয়তা বা অধিক অম্লত্ব থাকে না এবং উদ্ভিদ সহজেই তার খাদ্য মৌল সংগ্রহ করতে পারে। তবে pH 6.5 থেকে 7.5 থাকলে অধিক পরিমাণে উদ্ভিদ তাদের খাদ্যমৌল অতি সহজে সংগ্রহ করতে পারে।
১১. মাটির জৈব পদার্থ
মাটিতে যুক্ত জৈব পদার্থ পরবর্তীকালে হিউমাসে পরিণত হয় এবং এই হিউমাস মাটিতে কলয়েড সৃষ্টি করে।কলয়েড বিভিন্ন খনিজ লবণকে নিজের দেহে আবদ্ধ রাখে। ফলে কলয়েড যুক্ত মাটি উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য আদর্শ।
১২. পুষ্টি মৌল
উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং পুষ্টির জন্য পুষ্টি মৌল অতি প্রয়োজনীয়। মাটির মধ্যে থাকা নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম ইত্যাদি মৌলের উপস্থিতি উদ্ভিদের সুষম বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে। একারণে পুষ্টিমৌল সমৃদ্ধ মাটি অনেক বেশি উর্বর হয়।
মাটির উর্বরতা সংরক্ষণ এবং উর্বরতার উন্নতি সাধন
মাটির উর্বরতা সঠিকভাবে বজায় রাখা কৃষকদের কাছে একটি প্রধান সমস্যা।উর্বরতা সঠিকভাবে বজায় রাখতে হলে মাটি থেকে যেমন খাদ্য মৌলের অপচয় বন্ধ করতে হবে তেমনি গাছের খাদ্যের পরিমাণ বাড়াতে হবে। উর্বরতা বজায় রাখতে হলে নিচের বিষয়গুলির উপর নজর দিতে হবে।-
১. ভালোভাবে জমি চাষ
জমিকে ভালোভাবে চাষ করতে হবে। ভালোভাবে চাষ করলে অবশিষ্ট শস্য এর অংশ এবং আগাছা মাটির নিচে চাপা পড়ে যাবে। যা থেকে জৈব পদার্থ উৎপন্ন হবে এবং মাটির ভৌত, রাসায়নিক এবং জৈব অবস্থার পরিবর্তন ঘটাবে।
২. শস্যাবর্তন
প্রতিবছর জমিতে একই ফসল উৎপাদন করলে জমির মধ্যে থাকা খাদ্য উপাদানগুলি শেষ হয়ে যায়। ফলে মাটি অনুর্বর হয়ে পড়ে। বছরের বিভিন্ন সময়ে অথবা বিভিন্ন বছরে আলাদা আলাদা শস্যের চাষ করলে জমির উর্বরতা বাড়ে। ধান বা গমের মতো দানাশস্যের পর ডাল জাতীয় শস্য চাষ করলে জমিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বাড়ে ফলে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়।
৩. জমির উপযুক্ত ব্যবহার
জমির গুণ এবং বৈশিষ্ট্য অনুসারে শস্য চাষ করতে হবে। যেমন- বেলে মাটিতে আমন ধানের চাষ ভালো হয় না। আবার মাটি ক্ষয় হলে মাটির উর্বরতা কমে যায়। একারণে ঢাল যুক্ত অঞ্চলে বা পাহাড়ি ঢালে আড়াআড়ি ভাবে বা সারিবদ্ধ ভাবে ফসলের চাষ করলে ভূমির ক্ষয় আটকানো যায় এবং ফসল উৎপাদন করা যায়।
৪. জমিতে সবুজ সার তৈরি
শিম্বিগোত্রীয় কলাই, শিম, ধনচে, শন প্রভৃতি শস্য এবং অশিম্বিগোত্রীয় ভুট্টা, যব, জোয়ার, বাজরা প্রভৃতি চাষ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়।
৫. আচ্ছাদন সৃষ্টিকারী শস্যের চাষ
বরবটি, মিষ্টি আলু প্রভৃতি শস্য চাষ করলে মাটিতে একটা আবরণের সৃষ্টি হয়। এর ফলে বায়ুপ্রবাহ বা পৃষ্ঠ প্রবাহের মাধ্যমে মাটির ক্ষয় কম হয়। ফলে মাটির উর্বরতা বজায় থাকে।
৬. জৈব সারের প্রয়োগ
উদ্ভিদ থেকে পাওয়া জৈব সার, যেমন- খৈল, আবর্জনা সার, পাতা পচা সার ইত্যাদি এবং প্রাণীদের থেকে পাওয়া গোবর, হাড়ের গুঁড়ো, গোমূত্র ইত্যাদি প্রয়োগ করলে মাটির উর্বরতা বাড়ে।
৭. অজৈব সারের প্রয়োগ
জৈব সারের অভাবের ফলে এবং যে জৈব সার জমিতে প্রয়োগ করা হয়।জৈব সারের মধ্যে পুষ্টি মৌলের পরিমাণ কম থাকার ফলে এবং মাটির উর্বরতা বজায় রাখতে হলে অজৈব বা রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে।
৮. মাটির আর্দ্রতা সংরক্ষণ
গাছের ভালো বৃদ্ধির জন্য মাটিতে উপযুক্ত আর্দ্রতা থাকা প্রয়োজন। অতিরিক্ত জল মাটিতে থাকলে ধৌত প্রক্রিয়ায় খনিজ লবণ অপসারিত হয়। আবার মাটিতে জল না থাকলে উদ্ভিদ ভালোভাবে বৃদ্ধি পায় না। তাই মাটির অতিরিক্ত জল নিষ্কাশন করার মাধ্যমে মাটির আর্দ্রতা সঠিক রাখা প্রয়োজন।
৯. মাটির ক্ষয় রোধ
মাটির উপরের স্তরে উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য মৌল জমা থাকে। উপরের স্তর ক্ষয়প্রাপ্ত হলে খনিজ লবণ অপসারিত হয়, ফলে মাটির উর্বরতা কমে যায়। মাটির উপরিভাগের ক্ষয় বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
১০. আগাছা দমন
জমিতে অতিরিক্ত আগাছা জন্মালে মাটি থেকে গাছের খাদ্য মৌল শোষণ করে মাটিকে অনুর্বর করে। তাই জমির উর্বরতা রক্ষা করতে হলে প্রথমেই আগাছা দমন করতে হবে, যাতে আগাছা জমি থেকে অতিরিক্ত খাদ্য মৌল সংগ্রহ করতে না পারে।
১১. মাটিতে বায়ু এবং জল চলাচল
মাটিতে জল জমে থাকলে গাছের শিকড় ভালোভাবে জল শোষণ করতে পারেনা এবং উপকারী জীবাণুদের কাজ ভালোভাবে হয় না বলে মাটির উর্বরতা কমে যায়। একারণে গাছের জন্ম এবং বৃদ্ধির জন্য মাটিতে উপযুক্ত জল ও বায়ু চলাচল প্রয়োজন।
খ) মাটির উৎপাদিকা শক্তি বা উৎপাদন ক্ষমতা
মাটির শস্য উৎপাদনের ক্ষমতাকে বলে মাটির উৎপাদিকা শক্তি বা উৎপাদন ক্ষমতা। অনেক সময় মাটির উৎপাদিকা শক্তি সেই মাটি থেকে উৎপাদিত ফসলের মূল্য থেকে নির্ণয় করা হয়।
মাটির উর্বরতা, জলসেচ, জল নিষ্কাশন, ফসল উৎপাদনের উপযুক্ত জলবায়ু প্রভৃতি বিষয়ের উপর মাটির উৎপাদিকা শক্তি নির্ভরশীল।