জলনির্গম প্রণালী বা নদীনকশা কাকে বলে?
একটি নদী অববাহিকার মধ্যে প্রধান নদী ও তার উপনদীগুলি ভূ-তাত্ত্বিক, ভূমিরূপগত ও অন্যান্য প্রাকৃতিক কারণের দ্বারা প্রভাবিত হয়।ওই অববাহিকার প্রধান নদী ও তার উপনদীগুলি সামগ্রিকভাবে যে জ্যামিতিক আকৃতি গঠন করে, তাকে নদীনকশা বা ড্রেনেজ প্যাটার্ন বলে।
জলনির্গম প্রণালী বা নদীনকশা বিভিন্ন প্রকার হয়। যেমন-
ক) বৃক্ষরূপী জলনির্গম প্রণালী বা নদীনকশা (Dendritic Pattern)
প্রধানত ভূমি ঢালের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যে নদীনকশায় মূল নদীর সঙ্গে উপনদীগুলি, উপনদীর সঙ্গে প্রোউপনদীগুলি সূক্ষ্মকোনে মিলিত হয় এবং একটি গাছের শাখা প্রশাখার আকার ধারণ করে, তাকে বৃক্ষরূপী জলনির্গম প্রণালী বলে।
গ্রিক শব্দ "Dendron" কথাটির ইংরেজি প্রতিশব্দ 'Tree' যা থেকে "Dendritic" কথাটি এসেছে।
উদাহরণঃ
ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে বৃক্ষরূপী জলনির্গম প্রণালী দেখা যায়।
বৈশিষ্ট্যঃ
১. সরল প্রকৃতির একমুখী ঢালের উপর গড়ে ওঠে।
২. কিছুটা এলোমেলো ভাবে উপনদীগুলি সৃষ্টি হয়।
৩. নদীগুলি পরস্পর সূক্ষ্মকোণে মিলিত হয়।
৪. নদীগুলিকে একত্রে পাতাহীন শাখা-প্রশাখা যুক্ত বৃক্ষের মত দেখায়।
নিয়ন্ত্রকঃ
১. মৃদুঢালযুক্ত বা অনুভূমিকভাবে বিস্তৃত সমধর্মী পাললিক শিলাস্তরের উপরিভাগে গড়ে ওঠে।
২. দারণ ও ফাটলহীন নিরেট আগ্নেয় ও রূপান্তরিত অনুভূমিক শিলাস্তরের উপর গড়ে ওঠে।
৩. শিলার গ্রথন, প্রবেশ্যতা, কাঠিন্য এবং ক্ষয় প্রতিরোধ ক্ষমতা সর্বত্র একই রকম হলে এই ধরনের নদীনকশা গড়ে ওঠে।
বৃক্ষরূপী জলনির্গম প্রণালী দুই প্রকার। যথা-
i) উপ বৃক্ষরূপীঃ নকশাটি বেশ লম্বাটে ধরণের হলে তাকে উপ বৃক্ষরূপী নদী নকশা বলে।
ii) পিনেট বা চুনট নদীনকশা।
খ) সমান্তরাল জলনির্গম প্রণালী বা নদীনকশা (Parallel Pattern)
কোন নদী অববাহিকায় নদীগুলি পরস্পরের সমান্তরালে প্রবাহিত হলে তাকে সমান্তরাল জলনির্গম প্রণালী বলে।
উদাহরণঃ
হাজারীবাগ মালভূমির খাড়া প্রান্তদেশে, বিন্ধ্য পর্বতের ভৃগুঢালে, পশ্চিম উপকূলের তটভূমিতে দেখা যায়।
বৈশিষ্ট্যঃ
১. নদীগুলি মাঝারি এবং খাড়াঢালের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
২. নদীগুলি সোজা পথে প্রবাহিত হয়, গতিপথে বাঁক বিশেষ থাকে না।
৩. নদী গুলি পরস্পর সমান্তরাল।
৪. মূলনদী এবং উপনদীর সংখ্যা কম হয় এবং দৈর্ঘ্য বেশি হয় না।
নিয়ন্ত্রকঃ
১. সমান্তরাল চ্যুতি গঠিত অঞ্চলে সৃষ্টি হয়।
২. কঠিন ও কোমল শিলাস্তর সমান্তরালভাবে ভূপৃষ্ঠে উন্মুক্ত থাকলে সমান্তরাল নদীনকশা সৃষ্টি হয়।
৩. মালভূমির খাড়াঢালে সৃষ্টি হয়।
৪. একনত অথবা সমনত ভাঁজগঠিত অঞ্চলে সৃষ্টি হয়।
গ) জাফরিরূপী জলনির্গম প্রণালী বা নদীনকশা (Trellis Pattern)
"Trellis" কথার অর্থ "গাছে ওঠার ক্ষেত্রে সাহায্যকারী দন্ড" বা জাফরি।
কোন নদী অববাহিকায় প্রধান নদীর ( অনুগামী নদীর) সঙ্গে উপনদী (পরবর্তী নদী), উপনদীর সঙ্গে বিপরা এবং পুনর্ভবা নদীগুলি সমকোণে মিলিত হলে ঝিল্লি যুক্ত জানালা বা জাফরির মতো নকশা গঠন করে একে জাফরিরূপী নদী নকশা বলে।
উদাহরণঃ
আরাবল্লী পর্বতের পশ্চিম ঢালে, আসামের কাছাড় এলাকায়, দাক্ষিণাত্য মালভূমি, আমেরিকা যুক্ত রা শ্ত্রের অ্যাপালেশিয়ান পার্বত্য অঞ্চল, জুরা পর্বতে জাফরিরূপী নদীনকশা দেখা যায়।
বৈশিষ্ট্যঃ
১. পুরোপুরি ভূতাত্ত্বিক গঠন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
২. নদীগুলি পরস্পর সমকোণে মিলিত হয়।
৩. নদীগুলিকে দেখতে ঝিল্লির মত মনে হয়।
নিয়ন্ত্রকঃ
১. পরপর কঠিন ও কোমল শিলা গঠিত সমনতি গঠন যুক্ত অঞ্চলে গড়ে ওঠে।
২. বৃহৎ ভাঁজের প্রান্তদেশে গড়ে ওঠে।
৩. পরস্পর লম্বভাবে ছেদকারী ফাটলযুক্ত অঞ্চলে গড়ে ওঠে।
৪. সমান্তরালভাবে বিস্তারিত সৈকত বালিয়াড়ি বা গ্রাবরেখা গঠিত অঞ্চলে দেখা যায়।
ঘ) আয়তাকার জলনির্গম প্রণালী বা নদীনকশা (Rectangular Pattern)
প্রধান নদী ও তার উপনদীগুলি সমকোণে বাঁক নিয়ে প্রবাহিত হলে যে নদী-নকশা সৃষ্টি হয় তাকে আয়তাকার জলনির্গম প্রণালী বলে।
উদাহরণঃ
আরাবল্লী পর্বতের পশ্চিমাংশে, দাক্ষিণাত্য মালভূমির নদীগুলিতে দেখা যায়।
বৈশিষ্ট্যঃ
১. প্রধান নদী বা উপনদী গুলি সমকোণে বেঁকে প্রবাহিত হয়।
২. কখনো কখনো উপনদীগুলি সূক্ষকোণ বা স্থূলকোণে প্রধান নদীর সঙ্গে মিলিত হয়।
নিয়ন্ত্রকঃ
১. সমকোণে ছেদকারী ফাটল বা চ্যুতি গঠিত অঞ্চলে দেখা যায়।
২. গ্রানাইট ও বেলেপাথরে খুব বেশি পরিমাণ ফাটল থাকলে আয়তাকার নদী নকশা গড়ে ওঠে।
ঙ) বরশি বা আঁকশিরূপী জলনির্গম প্রণালী বা নদীনকশা (Barbed pattern)
যে ভূ-গঠন প্রভাবিত নদী নকশায় প্রধান নদীর গতিপথের সাথে উপনদী উল্টো দিকে প্রবাহিত হয়ে বরশি আঁকশির মত বেঁকে স্থূলকোণে প্রধান নদীর সাথে মিলিত হয়, তাকে বরশি বা আঁকশিরূপী জলনির্গম প্রণালী বলে।
বৈশিষ্ট্যঃ
১. উপনদী প্রধান নদীর বিপরীতে এসে মিলিত হয়।
২. নদীগ্রাসের ফলে এই ধরনের জলনির্গম প্রণালী গড়ে ওঠে।
৩. উপনদী প্রধান নদীর সঙ্গে স্থূলকোণে বাঁক নিয়ে মিলিত হয়।
নিয়ন্ত্রকঃ
১. ভূ-আলোড়নের কারনে নদী অববাহিকার শিলাস্তরের নতির স্থানীয় পরিবর্তন ঘটলে উপনদীরা প্রধান নদীর সাথে বরশি আকৃতির বাঁক সৃষ্টি করে মিলিত হয়।
২. নদীগ্রাসের ফলে মূল নদীর প্রবাহপথ পরিবর্তিত হয় বা বদলে যেতে পারে। ফলে মূল নদীর সাথে উপনদীরা যেখানে সাধারণত সূক্ষ্মকোণী মিলিত হয় সেখানে বরশি বা আঁকশিরূপী নদী নকশায় মূল নদীর সাথে উপনদী স্থূলকোণে বাঁক সৃষ্টি করে মিলিত হয়।
উদাহরণঃ
গোদাবরীর উপনদীর ইন্দ্রাবতী বড়শির মত বাঁক নিয়ে গোদাবরীতে মিলিত হয়েছে।
চ) অঙ্গুরীয় জলনির্গম প্রণালী বা নদীনকশা (Annular pattern)
গম্বুজ ভূ-গঠন অঞ্চলে পরস্পর বিন্যস্ত কঠিন ও কোমল শিলা স্তরকে অবলম্বন করে যে নদীজালিকায় নদীগুলি বলয়ের মত আকৃতি নিয়ে প্রবাহিত হয়। তাকে অঙ্গুরীয় জলনির্গম প্রণালী বলে।
উদাহরণঃ
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ব্ল্যাকহিল পাহাড় এবং হেনরি পাহাড়ে এই ধরনের জলনির্গম প্রণালী দেখা যায়।
বৈশিষ্ট্যঃ
১. পর্যায়ক্রমে কঠিন এবং কোমল শিলা গঠিত গম্বুজে দেখা যায়।
২. উপনদীগুলি গম্বুজের গা বেয়ে অনুভূমিকভাবে অগ্রসর হয়।
৩.নদীগ্রাসের ঘটনা দেখা যায়।
নিয়ন্ত্রকঃ
সাধারণত গম্বুজাকৃতি পাহাড় বা পর্বতে যেখানে কঠিন ও কোমল শিলা পর্যায়ক্রমে অবস্থান করে সেখানে ভূমির প্রাথমিক ঢাল বরাবর কেন্দ্রবহির্মুখী জলনির্গম প্রণালী গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে কোন কোন স্থানে নিচের কোমল শিলার বহিঃপ্রকাশ হলে সেখানে উপনদীর সৃষ্টি হয়, যা মূল নদীর সমকোণে পর্বতকে বেষ্টন করে প্রবাহিত হয়। পরবর্তীতে এই উপনদীগুলি আংটির মত আকার ধারণ করে।
ছ) কেন্দ্রবিমুখ জলনির্গম প্রণালী বা নদীনকশা (Radial Pattern)
কোন উচ্চভূমির ( গম্বুজ বা শঙ্কু) কেন্দ্রীয় অংশ থেকে চারপাশের ঢাল বেয়ে ছোট ছোট নদী বাইরের দিকে প্রবাহিত হয়ে যে নদী নকশা তৈরি করে তাকে কেন্দ্রবিমুখ জলনির্গম প্রণালী বলে।
উদাহরণঃ
ভারতের ছোটনাগপুর মালভূমির পরেশনাথ পাহাড়, হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ।
শ্রীলংকার মধ্যভাগে উচ্চভূমি থাকায় কেন্দ্রবিমুখ জলনির্গম প্রণালী গড়ে উঠেছে।
বৈশিষ্ট্যঃ
১. নদীগুলি উচ্চভূমির কেন্দ্রীয় অংশ থেকে চারদিকে নির্গত হয়।
২. কেন্দ্রবিমুখ নদীগুলি খরস্রোতা হয়।
৩. উপনদীর সংখ্যা কম থাকে।
নিয়ন্ত্রকঃ
গম্বুজাকৃতি ভূমি, শঙ্কুজাতীয় আগ্নেয়গিরি, অবশিষ্ট পাহাড় বা টিলা, ব্যাথোলিথ ও বস(Boss) জাতীয় ভূমিতে কেন্দ্রবিমুখ নদী নকশার সৃষ্টি হয়।
জ) কেন্দ্রমুখী জলনির্গম প্রণালী বা নদীনকশা (Centripetal pattern)
চারপাশের উচ্চভূমি থেকে উৎপন্ন নদীগুলি মধ্যভাগ বা কেন্দ্রের দিকে প্রবাহিত হয়ে যে নদী নকশা তৈরি করে তাকে কেন্দ্রমুখী নদীনকশা বলে।
উদাহরণঃ
উত্তরাখণ্ড রাজ্যের দেরাদুন উপত্যকায়, নেপালের কাঠমান্ডু উপত্যকা, মনিপুরের লোকটাক হ্রদ প্রভৃতি স্থানে দেখা যায়।
বৈশিষ্ট্যঃ
১. পর্বতবেষ্টিত অববাহিকা বা উচ্চভূমি বেষ্টিত অপেক্ষাকৃত নিচু অংশে দেখা যায়।
২. নদীগুলি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র হয়।
৩. মধ্যবর্তী অববাহিকায় হ্রদ সৃষ্টি হয়।
৪. অধিকাংশ নদীই অন্তর্বাহিনী হয়।
নিয়ন্ত্রক ঃ
১. চারপাশ উচ্চভূমি দ্বারা ঘেরা অববাহিকায় দেখা যায় ক্যালডেরা বা জ্বালামুখের চারদিকে
২. মরুভূমির প্লায়া হ্রদে দেখা যায়।
৩. দুটি ভাঁজের ঊর্ধ্বভঙ্গের মধ্যবর্তী অধোভঙ্গে দেখা যায়।
ঝ) বিনুনিরূপী জলনির্গম প্রণালী বা নদীনকশা (Braided pattern)
যখন মূল নদী বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় বিভক্ত হয়। ফলে নদীর প্রবাহপথ দ্বীপ ও চরের অবস্থানের জন্য পৃথক হয়। শাখা-প্রশাখা গুলি পুনরায় কিছুদূর যাওয়ার পর মিলিত হয়ে বিনুনি আকৃতি ধারণ করে।
উদাহরণঃ
উত্তরবঙ্গের তিস্তা, মহানদী প্রভৃতি নদীর পর্বত পাদদেশে দেখা যায়।
নদীর বদ্বীপ অঞ্চলে এইরকম জলনির্গম প্রণালী দেখা যায়।
ঞ) হেরিংবোন জলনির্গম প্রণালী বা নদীনকশা (Herringbone pattern)
যে নদী নকশায় উপনদীগুলি উভয় দিক থেকে এসে মূল নদীর সঙ্গে মুখোমুখি মিলিত হয় না বরং সামগ্রিকভাবে নদীবিন্যাস হেরিং মাছের কাঁটার আকৃতি ধারণ করে। একে হেরিংবোন নদীনকশা বলে।
উদাহরণঃ
ঝিলাম নদীর উচ্চপ্রবাহ, ঘর্ঘরার উপনদী রাপ্তির উচ্চ প্রবাহে এই রকম জল নির্গম প্রণালী দেখা যায়।
বৈশিষ্ট্যঃ
১. প্রধান নদী সরলরেখায় প্রবাহিত হয়।
২. উপনদীগুলিও প্রায় সরলরেখায় প্রবাহিত হয়।
৩. উপনদীগুলি প্রধান নদীর সঙ্গে মুখোমুখি মিলিত হয় না।
নিয়ন্ত্রক ঃ
১. এই ধরনের নদী নকশা চ্যুতি দ্বারা ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়।
২. পার্বত্য অঞ্চলে কোন নদী উপত্যকার দুপাশে সমন্তরাল শৈলশিরা অবস্থান করলে এই ধরনের নদী নকশা গড়ে ওঠে।