বৃষ্টিপাত এবং ভূ-গর্ভস্ত জল ভৌমজলের প্রধান উৎস। বৃষ্টির জল ভূপৃষ্ঠে পতিত হলে মৃত্তিকা কণার মধ্যে অবস্থিত ফাঁকা ছিদ্রের মধ্য দিয়ে এই জল মৃত্তিকার মধ্যে প্রবেশ করে। মৃত্তিকার রন্ধ্রের মধ্য দিয়ে জল প্রবেশ করাকে অনুস্রাবণ বলে। অনুস্রাবণের পরিমাণের ওপর ভৌমজলের পরিমাণ নির্ভর করে। অনুস্রাবণের মাত্রা কতকগুলি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যেমন-
ক) বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এবং স্থায়ীত্ব (Amount and Duration of Precipitation)
বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বলতে মোট কত পরিমান বৃষ্টিপাত হচ্ছে তা বোঝায় এবং স্থায়ীত্ব বলতে কতক্ষণ ধরে বৃষ্টি হচ্ছে সেটা বোঝায়। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি হলে মৃত্তিকা কণার মধ্য দিয়ে অনুস্রাবণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, ফলে বেশি পরিমাণ জল অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং ভৌমজলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায। এই কারণে যে অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি সেখানে ভৌমজলের পরিমাণ বেশি হয় এবং যে অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম সেখানে ভৌমজলের পরিমাণ কম হয়। এছাড়া ঋতুভেদে ভৌমজলের পরিমাণ বৃদ্ধি বা হ্রাস পায়। বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি হওয়ায় ভৌমজলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং শুষ্ক ঋতুতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম হওয়ায় ভৌমজলতল নিচে নেমে যায়।
বৃষ্টিপাতের স্থায়িত্বের উপর ভৌমজল অনেকাংশে নির্ভর করে। কম পরিমাণ বৃষ্টি অনেক বেশি সময় ধরে হলে অনুস্রাবণের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভৌমজলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে বেশি পরিমাণ বৃষ্টি খুব কম সময় ধরে হলে অধিকাংশ জল ভূমির ঢাল অনুসরণ করে প্রবাহিত হওয়ায় অনুস্রাবণের পরিমাণ হ্রাস পায়, ফলে ভৌমজলের পরিমাণ কমে যায়।
খ) মৃত্তিকার সচ্ছিদ্রতা (Porosity)
মৃত্তিকা কণার মধ্যে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অনেক ফাঁক বা রন্ধ্র থাকে। এই রন্ধ্র দিয়ে জল, বায়ু চলাচল করে। মৃত্তিকার মোট আয়তনের সাপেক্ষে ওই মৃত্তিকায় অবস্থিত ফাঁক বা রন্ধ্রের আয়তনের অনুপাতকে মৃত্তিকার সচ্ছিদ্রতা বলে।
সচ্ছিদ্রতার সূত্র হল, n = (w ÷ v) × 100
n = সচ্ছিদ্রতা, w = রন্ধ্রের মোট আয়তন, v = মৃত্তিকা বা শিলার মোট আয়তন
মৃত্তিকায় সচ্ছিদ্রতা বেশি হলে অনুস্রাবণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলে ভৌমজলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। সচ্ছিদ্রতা কম হলে ভৌমজলের পরিমাণ হ্রাস পায়। যেমন- বেলেমাটির সচ্ছিদ্রতার পরিমাণ বেশি থাকায় এই মাটিতে ভৌমজলের পরিমাণ বেশি।
গ) মৃত্তিকার প্রবেশ্যতা (Permeability)
মৃত্তিকা কণার মধ্য দিয়ে জল বা বায়ুচলাচল করাকে প্রবেশ্যতা বলে। প্রবেশ্যতা মৃত্তিকা কণার মধ্যবর্তী ফাঁক বা রন্ধ্রের আয়তনের উপর নির্ভর করে। রন্ধ্রের আয়তন বড় হলে তার মধ্য দিয়ে জল সহজেই প্রবেশ করতে পারে। ফলে ভৌমজলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। যেমন- বেলে মাটি ।
আবার রন্ধ্রের আয়তন সূক্ষ্ম হলে তার মধ্য দিয়ে জল এবং বায়ু সহজে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে ভৌমজলের পরিমাণ হ্রাস পায়। যেমন -কাদা মাটিতে সচ্ছিদ্রতা বেশি হলেও প্রবেশ্যতা অনেক কম থাকায় এই মাটিতে ভৌমজলের পরিমাণ কম। শিলার দারণ, ফাটল ইত্যাদি প্রবেশ্যতা বাড়ায়।
ঘ) ভূমির ঢাল (Slope of Land)
মৃত্তিকার রন্ধ্রগুলি খুব সূক্ষ্ম হওয়ায় সেখান থেকে খুব ধীরগতিতে অনুস্রাবণ প্রক্রিয়া কার্যকর হয়। ভূমির ঢাল অনুস্রাবণ প্রক্রিয়ার ওপর সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে। ভূমির ঢাল বেশি হলে জল পৃষ্ঠপ্রবাহ রূপে দ্রুত গড়িয়ে যায়, ফলে অনুস্রাবন প্রক্রিয়া কম হয় এবং ভৌমজলের পরিমাণ হ্রাস পায়। এই কারণে পার্বত্য, মালভূমি অঞ্চলে ভৌমজলের পরিমাণ কম।
অন্যদিকে সমভূমি অঞ্চলে ঢাল কম হওয়ায় জল ধীরগতিতে প্রবাহিত হয় অথবা কোন জলাশয় বা নিচু জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে, ফলে দীর্ঘ সময় ধরে অনুস্রাবণ প্রক্রিয়া কার্যকর হওয়ার ফলে ভৌমজলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
ঙ) বাষ্পীভবন (Evaporation)
বাষ্পীভবনের সঙ্গে ভৌমজলের বিপরীত সম্পর্ক রয়েছে। বাষ্পীভবনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে ভৌমজলের পরিমাণ হ্রাস পায় এবং যে সকল অঞ্চলে বাষ্পীভবনের পরিমাণ কম সেখানে ভৌমজলের পরিমাণ বেশি। শুষ্ক অঞ্চলে বাষ্পীভবনের মাত্রা বেশি হওয়ায় মৃত্তিকার অভ্যন্তরের ভৌমজল কৌশিক প্রক্রিয়ায় উপরে উঠে আসে এবং বাষ্পীভূত হয়। ফলে ভৌমজলের পরিমাণ কমে যায়।
চ) প্রবেশ্য এবং অপ্রবেশ্য শিলাস্তরের উপস্থিতি (Presence of Impermeable Rock Below Permeable Rock)
প্রবেশ্য শিলাস্তরের নিচে অপ্রবেশ্য শিলাস্তর থাকলে প্রবেশ্য শিলাস্তরের মধ্য দিয়ে জল প্রবেশ করে।অপ্রবেশ্য শিলাস্তরের বাধা পেয়ে জল তার উপর সঞ্চিত হয় এবং ভৌমজলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
ছ) ভূমি ব্যবহার (Character of Land Use)
ভূমি ব্যবহারের ধরন ভৌমজলের পরিমানকে নিয়ন্ত্রণ করে। শহর অঞ্চলের অধিকাংশ ভূমি কংক্রিটে ঢাকা থাকে বলে ভৌমজলের পরিমাণ কম হয়। অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে কৃষিজমি, পশুচারণ ক্ষেত্র প্রভৃতি উন্মুক্ত স্থান দিয়ে অনেক বেশি পরিমান জল ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করে, ফলে ভৌমজলের পরিমাণ বেশি হয়।
জ) উদ্ভিদের আবরণ (Vegetation Cover)
উদ্ভিদ আচ্ছাদিত অঞ্চলে বাষ্পীভবনের মাত্রা কম, জল দ্রুত গড়িয়ে যেতে পারে না। এছাড়া উদ্ভিদের শিকড় মাটিতে ফাটল এবং দারণের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। এর মধ্য দিয়ে জল ভূঅভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং ভৌমজলের পরিমাণ বৃদ্ধি করে।