ক) ক্ষয়জাত ভূমিরূপ
1. টেরারোসাঃ
ইতালিয় শব্দ 'Terra' যার অর্থ "কাদা" এবং 'rossa' যার অর্থ "লাল"। কার্বনিক অ্যাসিড মিশ্রিত বৃষ্টির জলের সঙ্গে চুনাপাথর দ্রবীভূত হয়ে যায় এবং লাল রঙের অদ্রবীভূত পদার্থ মৃত্তিকার উপরে স্তরে একটি আস্তরণ গড়ে তোলে।একে টেরারোসা বলে।
বৈশিষ্ট্যঃ
১. টেরারোসা লাল রঙের কাদার স্তর।
২. এর গভীরতা কয়েক মিটার থেকে কয়েকশো মিটার হয়।
৩. ক্রান্তীয় অঞ্চলে ল্যাটেরাইট মাটির মতো সঞ্চিত হয়।
গুরুত্বঃ
টেরারোসা থেকে বক্সাইট পাওয়া যায় যা অ্যালুমিনিয়াম উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়।
2. ল্যাপিস বা কারেনঃ
খাড়াঢাল যুক্ত চুনাপাথর অঞ্চলে দ্রবণ জনিত ক্ষয়কার্যের মাধ্যমে যে দীর্ঘ গর্ত বা খাঁজের সৃষ্টি হয় তাকে ল্যাপিস বা কারেন বলে।
বৈশিষ্ট্যঃ
১. কারেন 20 মিটার দীর্ঘ, 1 মিটার গভীর, 0.6 মিটার প্রস্থযুক্ত হয়।
২. কারেনগুলি সরলরৈখিক এবং সমান্তরালে অবস্থান করে।
৩. খাঁজগুলির শীর্ষ ভাগ তীক্ষ্ম এবং মধ্যভাগ উচ্চভূমির মত।
শ্রেণীবিভাগঃ
১. রিলেনকারেনঃ অতি সূক্ষ্ম কারেনগুলিকে রিলেনকারেন বলে।
২. রিনেনকারেনঃ রিলেনকারেনের চেয়ে বড় খাঁজগুলিকে রিনণেকারেন বলে।
৩. ট্রিটকারেনঃ সমতল তলদেশ বিশিষ্ট গর্ত গুলোকে ট্রিটকারেন বলে।
৪. রুন্ডকারেনঃ গোলাকার শিলাখণ্ড দ্বারা গঠিত কারেনকে রুন্ডকারেন বলে।
৫. ক্লুফটকারেনঃ দারণ যুক্ত শিলায় সৃষ্ট বড় বড় লম্বা খাতগুলিকে ক্লুফট কারেন বলে।
3. গ্রাইক এবং ক্লিন্টঃ
দারন বা ফাটল যুক্ত চুনাপাথর গঠিত অঞ্চলে দ্রবন কার্যের ফলে যে বৃহৎ এবং লম্বা খাতের সৃষ্টি হয় তাদের গ্রাইক বলে।
বৈশিষ্ট্যঃ
১. দেখতে পরিখার মতো হয়।
২. পরস্পর সমকোণে বিন্যস্ত থাকে।
৩. এগুলি 2 থেকে 4 মিটার চওড়া এবং 1 থেকে 5 মিটার গভীর হয়।
ক্লিন্টঃ
গ্রাইকগুলির মাঝে সমতল শীর্ষদেশ যুক্ত যে চাঁইয়ের আকারের উঁচু শিলাখণ্ড অবস্থান করে তাকে ক্লিন্ট বলে।
বৈশিষ্ট্যঃ
১. ভূপৃষ্ঠের উপর পাতলা মৃত্তিকার স্তর দিয়ে ঢাকা থাকে।
২. দেখতে ফানেল আকৃতির হয়।
৩. বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে একত্রে অবস্থান করে।
৪. গভীরতা কয়েক সেন্টিমিটার থেকে 30 মিটার পর্যন্ত হয়।
উদাহরণঃ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেনটাকিতে এবং ইন্ডিয়ানা প্রদেশে দেখা যায়।
4. সিঙ্কহোলঃ
চুনাপাথর গঠিত অঞ্চলে পরস্পর ছেদকারী জয়েন্ট বা দারণ অংশে দ্রবণজনিত ক্ষয়কার্যের ফলে যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গর্তের সৃষ্টি হয় তাদের সিঙ্কহোল বলে।এই ধরনের গর্ত সংখ্যায় কয়েক শত হতে পারে। সিঙ্কহোলগুলি উপরিভাগে মৃত্তিকার স্তর দ্বারা ঢাকা থাকতে পারে।
বৈশিষ্ট্যঃ
১. এগুলি শঙ্কু বা ফানেল আকৃতির হয়।
২. সিঙ্কহোলের উপরিভাগ পাতলা মিত্তিকা স্তর দ্বারা ঢাকা থাকে।
৩. এর গভীরতা ২ মিটার থেকে ১০ মিটার হয়।
৪. বিশাল অঞ্চল জুড়ে কয়েক শত সিঙ্কহোল একসঙ্গে অবস্থান করে।
উদাহরনঃ
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা প্রদেশে দেখা যায়।
5. সোয়ালোহোলঃ
দ্রবণজনিত ক্ষয়কার্যের ফলে সিঙ্কহোলগুলি আরও প্রসারিত হলে সিঙ্কহোলের উপরে অবস্থিত মৃত্তিকার আবরণ ধ্বসে পড়ে। এছাড়া একাধিক সিঙ্কহোল পরস্পর যুক্ত হয়ে সৃষ্টি হওয়া অপেক্ষাকৃত বড় গর্ত যার মধ্য দিয়ে বৃষ্টির জল ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তাকে সোয়ালোহোল বলে।
বৈশিষ্ট্যঃ
১. সোয়ালোহোলের মধ্যে নদী অদৃশ্য হয়।
২. শঙ্কু বা ফানেল আকৃতির হয়।
৩. গভীরতা 30 থেকে 50 মিটার পর্যন্ত হয়।
শ্রেণীবিভাগঃ
মূলত দুই প্রকার। যথা-
১. দ্রবণ সোয়ালোহোল ২. ধ্বস সোয়ালোহোল
উদাহরণঃ
ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের গ্যাপিংঘাইল সোয়ালোহোলটি বিখ্যাত।
6. পোনরঃ
যে নলাকৃতি পথে সোয়ালোহোল দিয়ে জল ভূগর্ভে প্রবেশ করে সেই পথ গুলিকে পোনরস্ (Ponors) বলে।
7. ডোলাইন বা ডোলিনঃ
সার্বিয়ান শব্দ 'Dolina" থেকে ডোলাইন কথাটির উৎপত্তি যার অর্থ ভূদৃশ্যের মধ্যে এক অবনমন। চুনাপাথর যুক্ত অঞ্চলে দ্রবনজনিত ক্ষয়কার্যের মাধ্যমে যে আবদ্ধ গর্তের সৃষ্টি হয় তাকে ডোলাইন বা ডোলিন বলে।
বৈশিষ্ট্যঃ
১. ফানেল আকৃতির হয়।
২. 2 থেকে 10 মিটার গভীর এবং 50 থেকে 100 মিটার ব্যাস যুক্ত হয়।
৩. ডোলাইনের পাড় খাড়া হয়।
শ্রেণীবিভাগঃ
উৎপত্তি অনুসারে পাঁচপ্রকার। যথা-
দ্রবন ডোলাইন
ধ্বস ডোলাইন
দ্রবণ পাইপ ডোলাইন
অবনত ডোলাইন
ককপিট ডোলাইন
উদাহরণঃ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা রাজ্যে অনেক ডোলাইন দেখা যায়।
8. উভালাঃ
দ্রবন কার্যের ফলে একাধিক সিঙ্কহোল বা ডোলাইন পরস্পর যুক্ত হয়ে যে বড় আকারের গর্তের সৃষ্টি করে তাকে উভালা বলে।
বৈশিষ্ট্যঃ
১. আয়তনে কয়েক হেক্টর হয়।
২. উভালা ছোট হলে তাকে jmmes বলে।
৩. অনুভূমিক স্তরের উপর উভালার আকৃতি উপবৃত্তাকার হয়।
9. পোলজি বা পোলজেঃ
কাস্ট অঞ্চলে উভালার চেয়ে বড় খাড়া পাড় যুক্ত গর্তকে পোলজি বা পোলজে বলে।
বৈশিষ্ট্যঃ
১. এর তলদেশ প্রায় সমতল হয়।
২. দেওয়াল খাড়া হয়।
৩. তলদেশে নদী প্রবাহিত হতে দেখা যায়।
উদাহরণঃ
যুগোস্লাভিয়ার লিভানো পোজির দৈর্ঘ্য 65 কিলোমিটার এবং প্রস্থ 5 থেকে 12 কিলোমিটার।
10. হামসঃ
অনেক সময় পোলজির মধ্যভাগে শঙ্কু আকৃতির পাহাড় দেখা যায় একে যুগোস্লাভিয়ায় হামস, পুয়ের্তোরিকোতে হে স্ট্যাক পাহাড় বা পেপিনো পাহাড়, কিউবাতে মোগোতে বলে।
11. অন্ধ উপত্যকাঃ
চুনাপাথর গঠিত অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত নদীর গতিপথে সিঙ্কহোল বা সোয়ালোহোল অবস্থান করলে গর্তের মধ্য দিয়ে নদীর জল ভূগর্ভে প্রবেশ করে। নদীর সিঙ্কহোল পর্যন্ত অংশে জল থাকে। তারপর নদীটি হারিয়ে যায়। নদীর এই জলপূর্ণ অংশকে অন্ধ উপত্যকা বলে।
বৈশিষ্ট্যঃ
১. এটি নদীর ঊর্ধ্ব উপত্যকার অংশ।
২. এই উপত্যকায় সবসময় জল থাকে।
৩. ক্ষয় কাজ বেশি হয় এবং উপত্যকা গভীর হয়।
৪. উপত্যকার বক্ষ নিচুতে অবস্থান করে।
৫. যে অংশে নদী ভূগর্ভে প্রবেশ করে সেই অংশকে সিঙ্ক বলে।
12. শুষ্ক উপত্যকাঃ
যেখানে নদী ভূগর্ভে প্রবেশ করে তার পরবর্তী অংশ শুষ্ক থাকে কোনোরূপ জলপ্রবাহ থাকে না। এই অংশকে শুষ্ক উপত্যকা বলে। শুধুমাত্র বর্ষাকালে এই অংশে জল থাকে।
বৈশিষ্ট্যঃ
১. ক্ষয়কাজ কম হওয়ায় এই উপত্যকা অগভীর হয়।
২. অন্ধ উপত্যকা তলদেশ অপেক্ষা শুষ্ক উপত্যকার তলদেশ উঁচুতে অবস্থান করে।
৩. শুধুমাত্র বর্ষাকালে এখানে জল থাকে।
13. কার্স্ট জানালাঃ
চুনাপাথর গঠিত অঞ্চলে নদী ভূ-অভ্যন্তরে সুড়ঙ্গ সৃষ্টি করে প্রবাহিত হয়। এই সুড়ঙ্গের ছাদটি স্থানে স্থানে ধসে যায় এই ধসে যাওয়া অংশ দিয়ে ভূপৃষ্ঠ থেকে গুহার মধ্যে প্রবাহিত নদী দেখা যায়। ভূগর্ভের নদীর এই দৃশ্যমান অংশকে কার্স্ট জানালা বলে।
উদাহরণঃ
মধ্যপ্রদেশের পাঁচমারিতে এই ধরনের কার্স্ট জানালা দেখা যায়।
14. স্বাভাবিক সেতু বা খিলানঃ
চুনাপাথর যুক্ত অঞ্চলে দ্রবনজনিত ক্ষয় কার্যের মাধ্যমে ভূগর্ভে সুড়ঙ্গের সৃষ্টি হয়। দ্রবন কার্যের মাধ্যমে সুড়ঙ্গের ছাদ ক্রমশ সরু হয়ে সেতুর মতো দেখায় একে স্বাভাবিক সেতু বলে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া প্ৰদেশে দেখা যায়।
15. কার্স্ট হ্রদঃ
ডোলাইনের তলদেশে অদ্রবীভূত মৃত্তিকার স্তর সঞ্চিত হলে তার উপর জল জমে যে হ্রদ সৃষ্টি হয় তাকে কাস্ট হ্রদ বলে।
খ) সঞ্চয়জাত ভূমিরূপ
চুনাপাথর গঠিত অঞ্চলে দ্রবনজনিত ক্ষয়কার্যের মাধ্যমে যে গুহার সৃষ্টি হয় সেখানে নানা প্রকার সঞ্চয়জাত ভূমিরূপ দেখা যায়। যেগুলোকে একত্রে কেভ ট্রাভারটাইন ( Cave travertine) বা স্পেলিয়োথেম (Speleothem) বলে । ব্রিটিশ ভূবিজ্ঞানী ডেভিস (W.M. Davis) এর মতে ভূ-অভ্যন্তরে তিন ধরনের সঞ্চয়জাত ভূমিরূপ গড়ে ওঠে। যথা-
অ) ড্রিপস্টোন বা পাতনপ্রস্তরঃ
চুনাপাথরের গুহার ছাদ থেকে জল পড়ার সময় জলের মধ্যে দ্রবীভূত চুন ফোটা ফোটা আকারে পড়ে যে ভূমিরূপ সৃষ্টি হয় তাকে ড্রিপস্টোন বা পাতনপ্রস্তর বলে। পাতনপ্রস্তরের উল্লেখযোগ্য ভূমিরূপগুলি হল-
1. স্ট্যালাকটাইটঃ
চুনাপাথর স্তরের ছাদ থেকে বট গাছের ঝুরির মত যে অংশ নিচের দিকে ঝুলতে থাকে তাকে স্ট্যালাকটাইট বলে।
উদাহরনঃ
ভারতের উত্তরাখণ্ডের তপোকেশ্বর গুহায় স্ট্যালাকটাইট দেখা যায়।
2. স্ট্যালাগমাইটঃ
গুহার ছাদ থেকে চুন মিশ্রিত জল ফোঁটার আকারে গুহার মেঝেতে পড়ে সেখানে উপর থেকে ওঠা চুনের স্তম্ভের সৃষ্টি হয় একে স্ট্যালাগমাইট বলে।
বৈশিষ্ট্যঃ
১. নিচের থেকে উপরের দিকে ক্রমশ উঁচু হয়।
২. ছোট হয় এবং মোটা হয়।
৩. এগুলি স্থায়ী হয়।
উদাহরণঃ
দেরাদুনের কাছে তপোকেশ্বর গুহায় দেখা যায়।
3. গুহাস্তম্ভ বা কেভ পিলারঃ
চুনাপাথরের গুহার ছাদ থেকে নেমে আসা স্ট্যালাকটাইট এবং মেঝে থেকে ওপরে ওঠা স্ট্যালাগমাইট বাড়তে বাড়তে যখন পরস্পর জুড়ে যায় তখন তাকে গুহাস্তম্ভ বা কেভ পিলার বলা হয়।
উদাহরণঃ
বক্সা জয়ন্তী পাহাড়ের মহাকাল গুহায় এই রকম অনেক স্তম্ভ দেখা যায়।
4. হেলিকটাইটঃ
গুহার ছাদ থেকে চুনাপাথর গঠিত অংশ তীর্যকভাবে বা বক্রভাবে বিভিন্ন দিকে আকারে বৃদ্ধি পেলে তাকে হেলিকটাইট বলে। ক্যালসিয়াম অক্সালেট দ্বারা গঠিত হয় বলে এগুলির আকার এমন হয়।
5. ড্রেপঃ
চুনাপাথরের গুহার ছাদে একাধিক স্ট্যালাকটাইট পরপর যুক্ত হয়ে যে ঝুলানো পর্দার মতো অংশ গঠিত হয় ড্রেপ বলে।
6. বেলহোলঃ
চুনাপাথরের গুহার ছাদে সৃষ্ট গম্বুজাকৃতির গর্তগুলোকে বেলহোল বলে।
7. রুফ পেন্ডেন্টঃ
চুনাপাথরের গুহার ছাদ থেকে বেরিয়ে থাকা ছুরির ফলার মতো আকৃতির প্রস্তরখন্ডকে রুফ পেন্ডেন্ট বলে।
আ) ফ্লোস্টোন বা প্রবাহ প্রস্তরঃ
চুনাপাথরের গুহার ভেতরে প্রবাহমান জলের মাধ্যমে সৃষ্ট ভূমিরূপকে ফ্লোস্টোন বা প্রবাহপ্রস্তর বলে।
ই) রিমস্টোন বা কিনারা প্রস্তরঃ
চুনাপাথরের গুহা বক্ষে উপচে পড়া জলপ্রবাহের মাধ্যমে গুহার দুই কিনারায় যে ভূমিরূপগুলি গড়ে ওঠে সেগুলিকে রিমস্টোন বা কিনারা প্রস্তর বলে। যুগোস্লাভিয়ার কাস্ট অঞ্চলে এই ধরনের ভূমিরূপ দেখা যায়।