খাদ্য শৃঙ্খল কি?
সবুজ উদ্ভিদ দিনের বেলায় সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় সৌরশক্তিকে রাসায়নিক শক্তিতে পরিণত করে। এই রাসায়নিক শক্তি স্থৈতিক শক্তিরূপে উদ্ভিদ কোষে আবদ্ধ হয়। উদ্ভিদ সরাসরি সৌরশক্তিকে নিজের দেহে আবদ্ধ করতে পারলেও অন্যান্য জীব করতে পারে না। একারণে সকল প্রাণীরা খাদ্যের জন্য বা শক্তির জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের দেহে আবদ্ধ শক্তির উপর নির্ভর করে।
তৃণভোজী প্রাণীরা সবুজ উদ্ভিদকে সরাসরি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে এবং শক্তি অর্জন করে। কিছু পরিমাণ শক্তি তাদের শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া-কলাপে ব্যবহার করার পর অবশিষ্ট শক্তি তাদের দেহে আবদ্ধ হয়। এই আবদ্ধ শক্তিকে পাওয়ার জন্য মাংসাশী প্রানীরা তৃণভোজী প্রাণীদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। মাংসাশী প্রাণীদের পরবর্তী খাদ্যস্তরের প্রাণীরা খেয়ে থাকে। এইভাবে খাদ্যশক্তি উৎপাদক থেকে প্রথম শ্রেণীর খাদক, প্রথম শ্রেণীর খাদক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীর খাদক এবং তারপর সর্বোচ্চ শ্রেণীর খাদকে পৌছায়। খাদ্যশক্তি বিভিন্ন খাদ্যস্তরে স্থানান্তরিত হওয়াকে খাদ্য শৃঙ্খল (Food Chain) বলে।
অন্যভাবে বলা যায় -" যে প্রক্রিয়ায় খাদ্যশক্তি উৎপাদক( সর্বনিম্ন পুষ্টিস্তর ) থেকে খাদ্য-খাদক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে সর্বোচ্চ পুষ্টিস্তরে স্থানান্তরিত হয়, তাকে খাদ্য শৃঙ্খল বলে "।
খাদ্যশৃঙ্খলের বৈশিষ্ট্যঃ
1. ভিত্তিঃ
খাদ্যশৃঙ্খলের মূল ভিত্তি হলো উৎপাদক বা সবুজ উদ্ভিদ। এই সকল উদ্ভিদ সৌরশক্তিকে সরাসরি রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে নিজেদর দেহে সঞ্চিত করে। যা পরবর্তী খাদ্যস্তরে স্থানান্তরিত হয়। কিছু কিছু খাদ্যশৃঙ্খল সবুজ উদ্ভিদ ছাড়াই শুরু হয়। যেমন- পরজীবী এবং মৃতজীবী খাদ্যশৃঙ্খল।
2. হ্রাসমান জীবসংখ্যাঃ
খাদ্যশৃঙ্খলের সর্বনিম্ন পুষ্টিস্তর থেকে জীবসংখ্যা সর্বোচ্চ পুষ্টিস্তরের দিকে ধীরে ধীরে কমতে থাকে । সর্বনিম্ন স্তর অর্থাৎ সবুজ উদ্ভিদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হয় এবং সর্বোচ্চ পুষ্টিস্তরে অবস্থিত জীবসংখ্যা সবচেয়ে কম হয়।
3. খাদ্যস্তরের সংখ্যাঃ
অধিকাংশ খাদ্যশৃঙ্খলে পুষ্টিস্তর বা খাদ্যস্তরের সংখ্যা 3 থেকে 5 পর্যন্ত হয়। কোন কোন খাদ্যশৃঙ্খলে এই সংখ্যা 7 পর্যন্ত হতে পারে।
4.একমুখী প্রবণতাঃ
খাদ্যশৃঙ্খলে শক্তির প্রবাহ একমুখী হয় অর্থাৎ উৎপাদক স্তর থেকে শক্তি সর্বোচ্চ খাদক স্তরের দিকে স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু এই শক্তি কখনই পুনরায় উৎপাদক স্তরের দিকে ফিরে আসে না।
5. জটিলঃ
কোন একটি বাস্তুতন্ত্রে একটিমাত্র খাদ্যশৃঙ্খল আলাদাভাবে বা বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান করে না বরং একাধিক খাদ্যশৃঙ্খল পরস্পর সংযুক্ত হয়ে অবস্থান করে। এর ফলে খাদ্যজাল তৈরি হয়।
খাদ্যশৃঙ্খলের শ্রেণীবিভাগ
জীবমন্ডলের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য খাদ্যশৃঙ্খল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খাদ্যশৃঙ্খলের কোন একটি স্তরের অনুপস্থিতি সমগ্র জীবমণ্ডলকে অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দিতে পারে। বিভিন্ন ভিত্তির ওপর নির্ভর করে খাদ্যশৃঙ্খলকে শ্রেণীবদ্ধ করা যায়। যেমন-
ক) খাদ্য ও খাদকের প্রকৃতির ভিত্তিতে
i) শিকারী খাদ্যশৃঙ্খল
এই খাদ্যশৃঙ্খল তৃণভোজী বা শাখাহারি প্রাণীদের থেকে শুরু হয় এবং খাদ্য-খাদক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে বৃহত্তর মাংসাশী প্রাণীর দিকে স্থানান্তরিত হয় বা শেষ হয়। একে শিকারী খাদ্যশৃঙ্খল বলে। যেমন-
গঙ্গা ফড়িং -------> ব্যাঙ --------> সাপ--- --> বাজপাখি
ii) পরজীবী খাদ্যশৃঙ্খল
যে খাদ্য শৃংখলের সকল পুষ্টিস্তরে জীবের আকার ক্ষুদ্র থেকে অতি ক্ষুদ্র হয় অথবা বৃহৎ জীব থেকে শুরু হয় এবং ক্ষুদ্র জীবে গিয়ে শেষ হয়। তাকে পরজীবী খাদ্যশৃঙ্খল বলে। এইরূপ খাদ্যশৃঙ্খলের বড় জীবকে বলে "Host" এবং অতি ক্ষুদ্র জীবকে বলা হয় পরজীবী বা "Parasite" । যেমন-
মানুষ --------> কৃমি -------> আদ্যপ্রাণী
iii) মৃতজীবী খাদ্যশৃঙ্খল
এই ধরনের খাদ্যশৃঙ্খলে জীবের মৃত বা পচিত দেহাবশেষ থেকে বিভিন্ন জীবাণুর দিকে শক্তি স্থানান্তরিত হয়। মূলত মৃতজীবী এবং বিয়োজোকের মধ্যে এই ধরনের খাদ্যশৃঙ্খল আবদ্ধ থাকে।যেমন-
মৃত উদ্ভিদ ------> ছত্রাক --------> ব্যাকটেরিয়া
খ) খাদ্য গ্রহণের ধরন অনুযায়ীঃ
i) চারণভূমি বা গ্রেজিং খাদ্যশৃঙ্খলঃ
যে সকল প্রাণীরা ঘুরে ঘুরে সবুজ উদ্ভিদকে বা উদ্ভিদের অংশকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে তাদের চারণপশু (Grazer) বলা হয়। চারণ ভিত্তিক খাদ্যশৃঙ্খল শুরু হয় সবুজ উদ্ভিদ থেকে। সবুজ উদ্ভিদকে তৃণভোজী প্রাণিরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। তৃণভোজী প্রাণীদের মাংসাশী প্রানীরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে এবং খাদ্যশক্তি পেয়ে থাকে। অন্যভাবে বলা যায়- " যে খাদ্যশৃঙ্খল উৎপাদক স্তর থেকে শুরু হয় এবং খাদ্যশক্তি মাংসাশী প্রাণীতে গিয়ে শেষ হয়, তাকে চারণভূমি বা গ্রেজিং খাদ্যশৃঙ্খল বলে"।
তৃণ ------> গঙ্গা ফড়িং ------> ব্যাঙ ------> সাপ ------> বাজপাখি
সবুজ উদ্ভিদ ------> প্রজাপতি ------> ব্যাঙ ------> সাপ ------> বাজপাখি
উদ্ভিদ প্লাংকটন ------> জলজ কীটপতঙ্গ ------>ছোট মাছ ------>বড় মাছ
ii) বিয়োজক খাদ্যশৃঙ্খল
সদ্য পতিত উদ্ভিদ এবং প্রাণীর দেহাবশেষের ওপর ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া , শ্যাওলা ইত্যাদি মৃতজীবী জীব জন্মায়। এই সকল মৃতজীবী জীবের দেহ থেকে নিঃসৃত উৎসেচকের প্রভাবে জীব বা জৈব দেহাবশেষের জটিল জৈব যৌগগুলি সরল যৌগে পরিণত হয় এবং শক্তি নির্গত হয়। এই প্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণ (Decomposition ) বা পচন বলে। পচনের সময় উৎপন্ন শক্তি এবং রাসায়নিক পুষ্টি পদার্থের কিছু অংশ এই সকল বিয়োজকের পুষ্টি এবং বৃদ্ধিতে কাজে লাগে। অবশিষ্ট অংশ পরিবেশে ফিরে যায়। জীবের দেহাবশেষ বা জৈববর্জ্য পদার্থ থেকে শক্তি ও পুষ্টি বিয়োজকের মধ্যে প্রবাহিত হওয়ার মাধ্যমে যে খাদ্যশৃঙ্খল রচিত হয় তাকে বিয়োজক খাদ্যশৃঙ্খল বলে।
মৃত ------> উদ্ভিদ ------> ছত্রাক ------> ব্যাকটেরিয়া
iii) জৈব অবশেষভোজী বা ডেট্রিটাস খাদ্যশৃঙ্খল
বিয়োজক অণুজীব, যেমন- ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, শ্যাওলা, জৈব দেহাবশেষ এবং জৈব বর্জ্য পদার্থগুলিকে বিশ্লেষণ এবং পচনের মাধ্যমে এক ধরনের অর্ধবিশ্লিষ্ট(semi-decomposed) জৈব পদার্থে পরিণত করে। একে জৈব অবশেষ (Detritus) বলে। যেসকল অণুজীব এই জৈব অবশেষগুলিকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে তাদের জৈব অবশেষভোজী বলে। জৈব অবশেষভোজী অণুজীবগুলি পুনরায় উচ্চস্তরের খাদক দ্বারা ভক্ষিত হয়। এইভাবে যে খাদ্যশৃঙ্খল রচিত হয় তাকে জৈব অবশেষভোজী খাদ্যশৃঙ্খল বলে।যেমন-
উদ্ভিদ দেহাবশেষ ------> কেঁচো ------> শ্যামা পাখি ------> বাজপাখি
খাদ্যশৃঙ্খলের গুরুত্বঃ
খাদ্যশৃঙ্খলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। যেমন-
i) পুষ্টিঃ
খাদ্যশৃঙ্খলে উৎপাদক স্তর থেকে পুষ্টি সমস্ত খাদ্যস্তরে সঞ্চারিত হয়।
ii) জীবজগতের অস্থিত্বঃ
খাদ্যশৃঙ্খল জীবজগতের অস্তিত্ব বজায় রাখে। খাদ্যশৃঙ্খলের কোন একটি স্তরের ক্রিয়া-কলাপ বিঘ্নিত হলে সমগ্র বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হয়।
iii) সুরক্ষিত বাস্তুতন্ত্রঃ
উদ্ভিদ ধ্বংস হলে খাদ্যশৃঙ্খল নষ্ট হয় এবং বাস্তুতন্ত্র বিঘ্নিত হতে পারে।
iv) খাদ্য-খাদক সম্পর্কঃ
খাদ্যশৃঙ্খল এর জীব-বৈচিত্র যত বেশি হবে ততই খাদ্য-খাদক সম্পর্ক সুগঠিত হবে।
v) সুগঠিত বাস্তুতন্ত্রঃ
খাদ্যশৃঙ্খল যত সংক্ষিপ্ত হবে বাস্তুতন্ত্র ততই সুগঠিত হবে।