বাস্তুতন্ত্রে একটি খাদ্যস্তর থেকে অপর খাদ্যস্তরে শক্তি স্থানান্তরিত হওয়ার সময় কিছু পরিমাণ শক্তি তাপশক্তি রূপে পরিবেশ ফিরে যাওয়ার জন্য পরবর্তী খাদ্যস্তরে মোট শক্তির পরিমাণ কমে যায়। এই কারণে পরবর্তী খাদ্যস্তরে কম পরিমাণ শক্তির স্তানান্তরিত হয়। ফলে জীবের সংখ্যা কমে যায়। কারণ বেশি সংখ্যক জীবকে পূর্ববর্তী খাদ্যস্তর শক্তির জোগান দিতে সক্ষম হয় না। এই কারণে নিম্ন খাদ্যস্তর থেকে উচ্চ খাদ্যস্তর পর্যন্ত জীবের সংখ্যা, ভর এবং স্থানান্তরিত শক্তিকে পরপর সাজালে যে শঙ্কু আকৃতির চিত্র পাওয়া যায় তাকে খাদ্য পিরামিড বলে।
বিজ্ঞানী জি. এলটন (G. Elton,1939) প্রথম এই খাদ্য পিরামিড এর ধারণা দেন। তার মতে "বাস্তুতন্ত্রে উৎপাদক থেকে সর্বোচ্চ খাদক পর্যন্ত জীবের সংখ্যা, শক্তি এবং ওজন ক্রমশ কমতে থাকে। এদের পরপর সাজালে যে চিত্র পাওয়া যায় তাকে খাদ্য পিরামিড বা বাস্তুতান্ত্রিক পিরামিড বলে"।
বৈশিষ্ট্যঃ
i) উৎপাদকের স্থানঃ
বাস্তুতন্ত্রে উৎপাদকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এই কারণে উৎপাদক পিরামিডের নিচে অর্থাৎ ভূমিতে অবস্থান করে।
ii) প্রাথমিক খাদকের স্থানঃ
খাদ্য পিরামিডে প্রাথমিক খাদকের স্থান উৎপাদকের ঠিক পরেই অর্থাৎ উপরে। প্রাথমিক খাদকের সংখ্যা উৎপাদকের তুলনায় কম হওয়ায় উপরে স্থান পেয়েছে।
iii) গৌণ খাদকের স্থানঃ
গৌণ খাদক এবং প্রগৌণ খাদক প্রাথমিক খাদকের ঠিক উপরে অবস্থান করে। কারণ এর সংখ্যা প্রাথমিক খাদক এর তুলনায় কম।
iv) শীর্ষস্থানঃ
প্রগৌণ খাদক পিরামিডের শীর্ষে অবস্থান করে। কোন কোন ক্ষেত্রে অন্য কোন শীর্ষ খাদক পিরামিডের সর্বোচ্চ স্থান দখল করে থাকে।
v) বিয়োজোকের অবস্থানঃ
খাদ্য পিরামিডের প্রতিটি স্তরেই বিয়োজোক অবস্থান করে।
বাস্তুতান্ত্রিক পিরামিড বা খাদ্য পিরামিডের শ্রেণীবিভাগঃ
বাস্তুতান্ত্রিক পিরামিড প্রধানত তিন প্রকারের হয় । যেমন-
1) জীব সংখ্যার পিরামিড (Pyramid of Numbers)
কোন একটি বাস্তুতন্ত্রে প্রতিটি খাদ্যস্তরের প্রতি একক ক্ষেত্রফলে যত সংখ্যক জীব পাওয়া যায় তাদের পরপর সাজালে যে পিরামিড পাওয়া যায় তাকে জীব সংখ্যার পিরামিড বলে। পিরামিডের ভূমিতে অবস্থান করে উৎপাদক বা সবুজ উদ্ভিদ। পরবর্তী খাদ্যস্তরে ( যেমন- প্রথম শ্রেণীর খাদক, দ্বিতীয় শ্রেণীর খাদক, তৃতীয় শ্রেণীর খাদক) জীবের সংখ্যা ক্রমশ কমতে থাকে। কোন একটি খাদ্যস্তরের জীবের সংখ্যার ওপর পরবর্তী খাদ্যস্তরের জীবের সংখ্যা নির্ভর করে।
জীব সংখ্যার পিরামিড |
যেমনঃ- চারণভূমিতে বা তৃণভূমির বাস্তুতন্ত্রে তৃণ বা ঘাসের তুলনায় তৃণভোজী প্রাণীর সংখ্যা কম। তৃণভোজী প্রাণীদের যেহেতু মাংসাশী প্রানীরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে একারণে মাংসাশী প্রাণীর সংখ্যা তৃণভোজী প্রাণির সংখ্যার তুলনায় কম হয়। মাংসাশী প্রাণীদের ওপর যে সকল প্রাণী নির্ভরশীল অর্থাৎ মাংসাশী প্রাণীদের যে সকল প্রাণীরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে তাদের সংখ্যা মাংসাশী প্রাণীর তুলনায় কম হয়।
2) জীবভরের পিরামিড বা বায়োমাসের পিরামিড (Pyramid of Biomass)
কোন বাস্তুতন্ত্রের নির্দিষ্ট খাদ্যস্তরে অবস্থিত জীবের শুষ্ক ওজনকে জীবভর বলা হয়। খাদ্য শৃঙ্খলের প্রতিটি স্তরের এই জীবভরকে পরপর সাজালে যে পিরামিড পাওয়া যায় তাকে জীবভরের পিরামিড বলে।
জীবভরের পিরামিড |
দেখা গেছে, কোন একটি খাদ্য শৃঙ্খলের একটি খাদ্যস্তরের 15 থেকে 20 শতাংশ জীবভর পরবর্তী খাদ্যস্তরে স্থানান্তরিত হয়। এই কারণে উৎপাদকের তুলনায় প্রথম শ্রেণীর খাদকের জীবভর কম হয় এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর খাদকের জীবভর প্রথম শ্রেণীর খাদকের তুলনায় কম হয়। যেমন- বনভূমির বাস্তুতন্ত্রে উৎপাদকের জীবভর সর্বাপেক্ষা বেশি হয় এবং সর্বোচ্চ স্তরের খাদকের জীবভর সবচেয়ে কম হয়।
3) শক্তির পিরামিড (Pyramid of Energy)
বাস্তুতন্ত্রে উৎপাদক বা সবুজ উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় সৌরশক্তিকে নিজেদের মধ্যে আবদ্ধ রাখে। যে পরিমান শক্তিকে সবুজ উদ্ভিদ নিজেদের মধ্যে আবদ্ধ করে তার কিছু পরিমাণ তার শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া-কলাপের জন্য ব্যয় করে। কিছু অংশ পরবর্তী খাদ্যস্তরে স্থানান্তরিত হয়। অর্থাৎ উৎপাদকের দ্বারা আবদ্ধ মোট সৌরশক্তি পরবর্তী খাদ্যস্তরের স্থানান্তরিত হয় না। একটি খাদ্যস্তর থেকে পরবর্তী খাদ্যস্তরে শক্তির স্থানান্তর 80 থেকে 90 শতাংশ কমে যায়।
শক্তির পিরামিড |
এই কারণে উৎপাদক থেকে প্রাথমিক খাদকে স্থানান্তরিত শক্তির পরিমাণ কম হয়। গৌণ খাদকে প্রাথমিক খাদক যে পরিমাণ শক্তি অর্জন করে তার থেকে কম পরিমাণে স্থানান্তরিত হয়। উৎপাদক থেকে শক্তি বিভিন্ন খাদ্যস্তরে স্থানান্তরকে যে পিরামিডের মাধ্যমে দেখানো হয় তাকে শক্তির পিরামিড বলে।
বিপরীত পিরামিডঃ
পরজীবী খাদ্য শৃঙ্খলে দেখা যায়। প্রথম শ্রেণীর খাদক এর তুলনায় দ্বিতীয় শ্রেণীর খাদকের সংখ্যা বেশি হয় এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর খাদক এর তুলনায় তৃতীয় শ্রেণীর খাদকের সংখ্যা বেশি হয়। বিভিন্ন পুষ্টিস্তরের খাদকের সংখ্যাকে পরপর সাজালে স্বাভাবিক পিরামিডের বিপরীত আকার ধারণ করে। একে বিপরীত পিরামিড বলে।
বিপরীত পিরামিড |
যেমনঃ মানুষের পেটে পরজীবী রূপে বসবাসকারী কৃমির সংখ্যা বেশি হয়। তেমনই কৃমির মধ্যে অবস্থিত আদ্যপ্রাণীর সংখ্যা কৃমির তুলনায় বেশি হয়। এই পিরামিডের ভূমিতে জীবের সংখ্যা কম এবং উপরিভাগে বেশি হয়।