মৃত্তিকা ক্ষয়ের জন্য প্রধান দুটি প্রাকৃতিক শক্তি হলো জল এবং বায়ুপ্রবাহ। এদের সম্পর্কে সংক্ষেপে নিম্নে আলোচনা করা হল-
ক) জলের দ্বারা বিভিন্ন প্রকার মৃত্তিকা ক্ষয়:
বৃষ্টির জল বা জলপ্রবাহ প্রভৃতির দ্বারা মৃত্তিকার উপরের পদার্থ আলগা হয়ে পড়ে এবং মৃত্তিকা ক্ষয়ের সৃষ্টি করে। ইহা কয়েক প্রকার লক্ষ্য করা যায়। যেমন-
a) কর্দমাক্ত ক্ষয়(Splash Erosion):
বৃষ্টির কনা উদ্ভিদ আচ্ছাদনহীন বা কর্ষিত ভূমিভাগের উপর পড়লে মৃত্তিকার কনা সমষ্টি ভেঙে গিয়ে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম মৃত্তিকা কণায় পরিণত হয় যা বৃষ্টির জলের সঙ্গে শূন্যে লাফিয়ে ওঠে এবং পুনরায় ভূমিতে পতিত হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় কর্দমাক্ত ক্ষয়।
কর্দমাক্ত ক্ষয়ের ফলে মৃত্তিকার উপরের স্তরে সূক্ষ্ম মৃত্তিকা কণার মধ্যবর্তী ছিদ্রগুলি বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে বৃষ্টির জল মৃত্তিকার গভীরে পৌঁছতে পারেনা। এই অবস্থায় বৃষ্টিপাত হতে থাকলে ধীরে ধীরে মৃত্তিকার উপরিভাগের কনাগুলি বৃষ্টির জলের সঙ্গে অন্য স্থানে প্রবাহিত হয়।
b)পত্র ক্ষয় বা চাদর ক্ষয়(Sheet Erosion):
সমানভাবে ঢালু কোন ভূমির ওপর দিয়ে জল প্রবাহিত হয়ে মৃত্তিকার উপরিভাগের সূক্ষ্ম স্তর সমানভাবে অপসারিত হলে তাকে পত্র ক্ষয় বা চাদর ক্ষয় বা Sheet Erosion বলে। এই ধরনের ক্ষয় এত ধীর প্রক্রিয়ায় হয় যে খালি চোখে দেখলে অনুভব করা যায় না। আস্তে আস্তে মৃত্তিকা ফ্যাকাসে হয়ে পড়ে। কৃষি জমিতে চাদর ক্ষয়ের ফলে উর্বরাশক্তি হ্রাস পায়। ফলে চাষাবাদ করার জন্য সার প্রয়োগ করতে হয়। এই ধরনের ক্ষয় ভূ-প্রাকৃতিক গঠন, জলবায়ু এবং মৃত্তিকার ক্ষয় প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর নির্ভর করে।
c) চ্যানেলাইজড ক্ষয়(Channelised Erosion):
Channel বা খাত সৃষ্টি করে যদি মৃত্তিকা ক্ষয় হয় তাকে চ্যানেলাইজড ক্ষয়(Channelised Erosion) বলে। এই ধরনের ক্ষয় কয়েক প্রকারের হয়-
i) নালি ক্ষয়( Rill Erosion):
যখন ঢালযুক্ত ভূমিভাগের সমগ্র স্থান থেকে মৃত্তিকা সমানভাবে অপসারিত না হয়ে জল ধারা সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম প্রবাহপথ এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে তখন ক্ষয়ের পরিমাণ কিছুটা হলেও বেশি হয়। এই প্রকার মৃত্তিকা ক্ষয়কে জলনালিকা বা নালি ক্ষয় বা Rill Erosion বলে। প্রবল বৃষ্টিপাত এই প্রকার ক্ষয়কার্যের জন্য দায়ী। মরু অঞ্চলে প্রবল বৃষ্টি হলে এই প্রকার ক্ষয়কার্য পরিলক্ষিত হয়।
ii) খাত ক্ষয়(Gully Erosion):
ঢালের কারণে বৃষ্টির জলধারা যদি সম্মিলিত হয়ে প্রবাহিত হয়, তখন নালিকা সমূহ বেশ কিছুটা গভীর এবং স্পষ্ট হয়ে যায়। এইরকম অপেক্ষাকৃত গভীর এবং স্পষ্ট নালিকে খাত বলে। যে ধরনের ক্ষয়কার্যের ফলে খাত সৃষ্টি হয় তাকে খাত ক্ষয় বা Gully Erosion বলে। নালি ক্ষয়( Rill Erosion) ক্রমশ বিস্তৃত হয়ে খাত ক্ষয়( Rill Erosion) ঘটায়।
এই ধরনের ক্ষয়ের ফলে যে খাতগুলি সৃষ্টি হয় সেগুলি আকৃতিগত দিক থেকে তিন প্রকারের-
- 'V'আকৃতির: মৃত্তিকার নিম্নস্তর ভারী গ্রহণ যুক্ত হলে নিম্নক্ষয় কম হয়। ফলে 'V' আকৃতির আকার ধারণ করে।
- 'U' আকৃতির: যে সকল স্থানে সংকীর্ণনালিকা গুলি কোমল শিলা গঠিত অঞ্চলে অবস্থিত সেখানে 'U' আকৃতির খাত সৃষ্টি হয়।
- 'U' এবং 'V' আকৃতির : মৃত্তিকার উপরিভাগে কঠিন শিলাস্তর এবং নিচে কোমল শিলাস্তর অবস্থান করলে কঠিন শিলাস্তর এর উপরে 'V' আকৃতির এবং কোমর শিলাস্তরের উপরে 'U' আকৃতির খাত সৃষ্টি হয়।
iii) রাভাইন(Ravine) :
উদ্ভিদহীন অপেক্ষাকৃত অধিক ঢালু ভূমিতে জলের দ্বারা ক্ষয় মারাত্মক আকার ধারণ করে। এরপর খাতগুলি আরো গভীর হয়ে পড়ে। যাদের পার্শ্বদেশ বা পাড় খুব খাড়া হয়। এইরূপ খাড়া পাড় যুক্ত তুমিকে রাভাইন(Ravine) বলে। রাভাইনের খাত গুলি সংকীর্ণ নালিকার তুলনায় গভীর কিন্তু গিরিখাত এর তুলনায় কম গভীর হয়। মেদিনীপুরের গরবেতা অঞ্চলের গণগণিতে এইরূপ রাভাইন সৃষ্টি হয়েছে।
খ) বায়ুর দ্বারা মৃত্তিকা ক্ষয়:
জলের ন্যায় বায়ুর দ্বারা মৃত্তিকা ক্ষয় ব্যাপক আকার ধারণ করে। বায়ুর প্রবাহপথের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় মৃত্তিকার উপরিস্তরের আলগা পদার্থ তার সঙ্গে বয়ে নিয়ে যায়। যে স্থান যত সূক্ষ্ম মৃত্তিকা কনা দ্বারা গঠিত সেখানে ততো বেশি ক্ষয় পরিলক্ষিত হয়। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অধিক হলে বায়ুর দ্বারা মৃত্তিকা ক্ষয় ততটা দেখতে পাওয়া যায় না । কোন স্থান তার স্বাভাবিক উদ্ভিদের আবরণ দ্বারা আবৃত থাকলে সেখানে বায়ুর ক্ষয়কার্য এতই কম হয় যে মৃত্তিকার গঠন প্রক্রিয়া দ্বারা তা পূরণ হয়ে যায়। একে ভূতাত্ত্বিক ক্ষয় (Geological Erosion) বলে। অন্যদিকে উদ্ভিদের আবরণ এর পরিমাণ কম হলে বায়ু বেশি পরিমাণ পদার্থ সংগ্রহ করতে পারে এবং এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যায়। বাতাসে ঘূর্ণির পরিমাণ বেশি হলে ক্ষয়কার্য বেশি হয়।