সংজ্ঞা ও ধারণা
বৃষ্টির জল বা বায়ুপ্রবাহ ভূপৃষ্ঠের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় ভূমি ভাগের সঙ্গে ঘর্ষণ হয়; যা মৃত্তিকা কণাকে আলগা করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বাহিত করে নিয়ে যায়। একে মৃত্তিকা ক্ষয় বলে। শুধুমাত্র জল প্রবাহ এবং বায়ু মৃত্তিকা ক্ষয় করতে সাহায্য করে না। অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান, যেমন- হিমবাহ, সমুদ্রতরঙ্গ প্রভৃতি মৃত্তিকা ক্ষয়ে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু বায়ুপ্রবাহ এবং জলের দ্বারা ক্ষয়কার্য পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র লক্ষ করা যায়। ফলে বলা যায় যে মৃত্তিকা ক্ষয়ের পধান কারণ হলো জলপ্রবাহ এবং বায়ু চলাচল। এছাড়া মানুষের বিভিন্ন ক্রিয়া-কলাপ এর ফলে মৃত্তিকা ক্ষয় হতে পারে।
মৃত্তিকা ক্ষয় এবং মৃত্তিকার উৎপত্তি এর সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে মৃত্তিকা ক্ষয়কে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়।
যে পরিমাণ মৃত্তিকা বায়ু অথবা জলের দ্বারা অপসারিত হয় ঠিক তত পরিমাণ মৃত্তিকা যদি নিম্নে অবস্থিত জনক শিলা থেকে সৃষ্টি হয় তাকে মৃত্তিকার স্বাভাবিক ক্ষয় বা ভূতাত্ত্বিক ক্ষয় বলে। অন্যদিকে মৃত্তিকা উৎপাদনের হারের তুলনায় যদি বেশি পরিমাণ মৃত্তিকা অপসারিত হয় তাহলে তাকে প্রধানত মৃত্তিকা ক্ষয় হিসাবে অভিহিত করা হয়।
মৃত্তিকা ক্ষয়ের কারণ অথবা নিয়ন্ত্রক
1968 সালে এম মরিসওয়া মৃত্তিকা ক্ষয়ের ক্ষেত্রে দুটি নিয়ন্ত্রকের কথা উল্লেখ করেছিলেন। যথা-
A. জলবায়ু:
বৃষ্টিপাতের তীব্রতা, পরিমাণ এবং স্থায়ীত্ব একদিকে যেমন স্বাভাবিক উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য ও ঘনত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনি উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য আবার বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, স্থায়িত্ব ইত্যাদিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ সকল উপাদান মৃত্তিকা ক্ষয়কে নিয়ন্ত্রণ করে।
B. ভূতাত্ত্বিক গঠন:
শিলার প্রকৃতি, ভূমির প্রকৃতি প্রভৃতি বিষয়গুলি সরাসরি মৃত্তিকা ক্ষয়কে নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবিত করে এবং পরোক্ষভাবে জলবায়ুকে প্রভাবিত করে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে স্বাভাবিকভাবে মৃত্তিকা ক্ষয় নিয়ন্ত্রনকারী উপাদানগুলি হল ভূ-প্রকৃতি, স্বাভাবিক উদ্ভিদ এবং মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্য এই নিয়ন্ত্রক গুলিকে একটি সমীকরণের সাহায্যে প্রকাশ করা যায়।
E=f(C,T,R,V,S)
যেখানে-
E =মৃত্তিকা ক্ষয়
C =জলবায়ু
T = ভূ-প্রকৃতি
R= শিলার প্রকৃতি
V =উদ্ভিদ
S =মৃত্তিকার প্রকৃতি
পরবর্তীকালে এই সমীকরণকে নিন্মলিখিতভাবে প্রকাশ করা হয়।
E=f(R,K,L,S,C,P)
যেখানে-
R= বৃষ্টিপাত এবং জলপ্রবাহ (Rainfall)
K= মৃত্তিকা ক্ষয়যোগ্যতা ( Erodirity of Soil)
L= ঢালের দৈর্ঘ্য (Length of the Slope)
S =ভূমির ঢাল (Degree of Slope)
C =শস্য চাষ ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত রাশি ( Nature of Crop)
P= ক্ষয় নিরোধক ব্যবস্থাসমূহ ( Conservative Practicles)
1. জলবায়ু সংক্রান্ত কারণ(R)
মৃত্তিকা ক্ষয় প্রধানত বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এবং জলপ্রবাহের উপর নির্ভর করে। বৃষ্টিপাতের মোট পরিমাণ থেকে বৃষ্টিপাতের তীব্রতা অর্থাৎ প্রতি ঘন্টায় কি পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয় তার ওপর বেশি মৃত্তিকা ক্ষয় এর পরিমাণ নির্ভর করে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি অপেক্ষা মুষলধারে বৃষ্টিপাতে মৃত্তিকা ক্ষয় বেশি হয়। মরু অঞ্চলে মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম হলেও যে পরিমান বৃষ্টি হয় তা মুষলধারে হওয়ার ফলে মৃত্তিকা ক্ষয় বেশি হয়।
প্রতি মাসের তুলনায় যদি বছরে কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ে বা নির্দিষ্ট মাসে বৃষ্টিপাত বেশি হয়ে থাকে তাহলে মৃত্তিকা ক্ষয় বেশি হয়।
মৌসুমি বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চলের শুষ্ক গ্রীষ্ম ঋতুতে উদ্ভিদ আবরণ প্রায় থাকেনা। এই সময় প্রচুর বৃষ্টিপাত হলে মৃত্তিকা ক্ষয় বেশি হয়। কর্ষিত জমিতে মৃত্তিকা আলগা থাকার জন্য মৃত্তিকা ক্ষয় বেশি হয়।
2. মৃত্তিকার ক্ষয় যোগ্যতা (K)
সকল মৃত্তিকা সমানভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়না। একই পরিমাণ বৃষ্টিপাত হলে কোন কোন মৃত্তিকা বেশি পরিমাণ ক্ষয় হয় এবং অন্য মৃত্তিকার ক্ষয় তুলনামূলকভাবে কম হয়। মৃত্তিকা ক্ষয় কম বা বেশি হবে তার কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে-
a. মৃত্তিকার জল চুইয়ে নামার ক্ষমতা:
ভূপৃষ্ঠে পতিত জলের কিছু পরিমাণ বাষ্পীভূত হয়। কিছু পরিমাণ ভূপৃষ্ঠ বরাবর পরিবাহিত হয় এবং কিছু পরিমাণ জল মৃত্তিকার অভ্যন্তরে চুইয়ে প্রবেশ করে। যত বেশি পরিমান জল চুইয়ে প্রবেশ করে তত কম পরিমাণ মৃত্তিকা ক্ষয় হয়। মৃত্তিকার অভ্যন্তরে জল চুয়ানোর পরিমাণ দুটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে-
i. মৃত্তিকার গঠণের উপর:
মৃত্তিকার গঠণের ওপর জলের পরিমাণ নির্ভর করে। যে মাটির কনা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে ছোট ছোট গুটি সৃষ্টি করে মৃত্তিকার গঠন সৃষ্টি করে সেই মাটিতে চুয়ানোর পরিমাণ বেশি হয় ফলে জলের পৃষ্ঠপ্রবাহ কম হয়। ফলে মৃত্তিকা ক্ষয় কম হয়। মৃত্তিকা গঠন সৃষ্টি না হলে চুয়ানোর পরিমাণ কম হয়। ফলে পৃষ্ঠপ্রবাহ বেড়ে গিয়ে মৃত্তিকা ক্ষয় অধিক হয়।
ii . মৃত্তিকার গ্রথন এর ওপর:
মৃত্তিকার গ্রথন যত হালকা হবে মৃত্তিকা জল চুয়ানোর পরিমাণ তত বৃদ্ধি পাবে। ফলে মৃত্তিকা ক্ষয় কম হবে। ভারী গ্রথন যুক্ত মৃত্তিকায় জলের পরিমাণ কম হওয়ায় পৃষ্ঠ প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়ে মৃত্তিকা ক্ষয় অধিক হয়।
b. মৃত্তিকার গঠন:
কর্দম মৃত্তিকা গঠনহীন হলে রন্ধ্রগুলি সূক্ষ্ম কর্দমকণা দ্বারা পূর্ণ হয়। ফলে নিম্নগামী জলের পরিমাণ কমে যায় এবং মৃত্তিকা ক্ষয় বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে কর্দমকণা গুটি সৃষ্টি করলে চুয়ানো জলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ফলে মৃত্তিকা ক্ষয় হ্রাস পায়।
c. জৈব পদার্থ:
মৃত্তিকার উপরের স্তরে জৈব পদার্থের আবরণ থাকে। ফলে এই পদার্থ মৃত্তিকাকে সরাসরি বৃষ্টির ফোটার আঘাত থেকে রক্ষা করে। ফলে মৃত্তিকা ক্ষয় পরোক্ষভাবে হ্রাস পায়।
3. ভূমি ঢালের দৈর্ঘ্য (L)
ভূমির ঢালের দৈর্ঘ্য মৃত্তিকা ক্ষয়কে প্রভাবিত করে। ভূমির ঢালের দৈর্ঘ্য বেশি হলে মৃত্তিকা ক্ষয় বেশি হয়। গবেষণায় দেখা গেছে শতকরা 60 ভাগ ভূমির ঢাল যুক্ত অঞ্চলে ঢালের দৈর্ঘ্য দ্বিগুণ হলে মৃত্তিকা ক্ষয় 2.6 গুণ বৃদ্ধি পায়।
4. ভূমির ঢাল (S)
মৃত্তিকা ক্ষয়ের ক্ষেত্রে ভূমির ঢাল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভূমির ঢালের ক্ষেত্রে মৃত্তিকা ক্ষয় নির্ভর করে ভূমির ঢালের পরিমাণের উপর। ভূমির ঢাল বেশি হলে প্রবাহমান জলের দ্বারা মৃত্তিকা সহজেই পরিবাহিত হয়ে যায়। ঢাল কম হলে মৃত্তিকা ক্ষয় কম হয়।এর কারণ এই যে ঢাল বেশি হলে অধিক জল প্রবাহিত হয় এবং তার সঙ্গে প্রবাহের গতি বৃদ্ধি পায়। দেখা গেছে যে, প্রবাহের গতি দ্বিগুন হলে ওই প্রবাহে 64 গুণ বেশি মৃত্তিকা কনা অপসারণ করতে পারে। ভাসমান পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে হয় 32 গুন আর মৃত্তিকা ক্ষয়ের মোট পরিমাণ হয় 4 গুণ।
5. শস্য চাষ এবং অন্যান্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত রাশি (C)
ভূমিভাগ কি জাতীয় শস্য দ্বারা আবৃত থাকে তার ওপর মৃত্তিকা ক্ষয় অনেকাংশে নির্ভর করে। বনভূমি এবং ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ দ্বারা আচ্ছাদিত জমিতে মৃত্তিকা ক্ষয় কম হয়। অন্যদিকে ডাল জাতীয় শস্য এর স্থান তারপরেই। অন্যদিকে ভুট্টা ইত্যাদি চাষ মৃত্তিকা ক্ষয় হতে সাহায্য করে।
6. ক্ষয় নিরোধক ব্যবস্থাসমূহ (P)
মানুষের প্রয়োজনে মানুষ কৃষি জমি কর্ষণ করে, ফলে ভূমিক্ষয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এই ক্ষয় কিছুটা রোধ করা যেতে পারে। সমোন্নতি রেখা বরাবর চাষ, ফালি চাষ, ধাপ চাষ, জল নিকাশের ধারে ঘাস চাষ ইত্যাদি করলে মৃত্তিকা ক্ষয় কিছুটা কমানো যেতে পারে।